রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির তথ্য গোপন করায় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পার্লামেন্ট সদস্যপদ খারিজ এবং তাঁকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)।
চলতি বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরানের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে পাকিস্তানজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করছে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক–ই ইনসাফ (পিটিআই)। এরই মধ্যে শুক্রবার তাঁকে পার্লামেন্ট নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হলো।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজার নেতৃত্বে ইসিপির পাঁচ সদস্যের প্যানেল এই রায় দেয়। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বিদেশ থেকে পাওয়া উপহারের তথ্য গোপন করে আইনের লঙ্ঘন করেছেন। তিনি কিছু উপহার বিক্রিও করেছেন।
সংবিধানের যে ৬৩(১)(পি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইমরান খানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তাতে তিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করতে পারবেন না। পাকিস্তানি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইন অনুযায়ী তিনি পাঁচ বছর নির্বাচন করতে পারবেন না।
অবশ্য ইমরান খানের আইনজীবী গোহার খান বলেছেন, ইসির রায় অনুযায়ী এই পার্লামেন্টের মেয়াদে কোনো নির্বাচন করতে পারবেন না ইমরান। এই পার্লামেন্টের মেয়াদ শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে। তাঁরা কমিশনের এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, তোশাখানা বিতর্ক শুরু হয়েছিল গত বছর। ইমরান খান ও তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি রাষ্ট্রীয় তোশাখানা থেকে ছাড় মূল্যে উপহার কিনে পরে সেগুলো বাজারে বিক্রি করেছেন—এমন তথ্য প্রকাশ্যে এলে এ বিতর্ক শুরু হয়।
তোশাখানা থেকে ইমরান খানের নেওয়া উপহারের বিষয়ে শুরুতে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশে অনীহা দেখায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল পিটিআই। দলটির দাবি ছিল, এতে পাকিস্তানের বৈদেশিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাকিস্তানে তোশাখানা দপ্তর ১৯৭৪ সালে চালু হয়েছিল। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, আইনপ্রণেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ থেকে পাওয়া উপহার সেখানে সংরক্ষণ করা হয়। তোশাখানা নীতি অনুযায়ী, সব উপহার এই বিভাগে জমা দিতে হবে। তবে উপহার পাওয়া ব্যক্তি উপহারগুলো ছাড়মূল্যে কিনে নিতে পারবেন।
মামলার বরাত দিয়ে জিও নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তোশাখানা থেকে ৫২টি উপহার নিয়েছেন। তিনি আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে নামমাত্র মূল্যে এসব উপহার কিনে নেন। অধিকাংশ উপহার তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন।
এসব উপহারের আনুমানিক মূল্য ১৪ কোটি ২০ লাখ রুপি। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর থাকাকালে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব উপহার নিজের জিম্মায় নিয়েছিলেন। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, উপহারের মধ্যে কয়েকটি দামি হাতঘড়ি, একটি আংটি ও এক জোড়া কাফ লিংক (এক ধরনের বোতাম) ছিল।
মামলায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মামলার আবেদনকারী ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) পার্লামেন্ট সদস্য মোহসিন নেওয়াজ বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিজের, তাঁর স্ত্রীর এবং নির্ভরশীলদের সব সম্পদের হিসাব প্রতিবছর নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদি এটা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে ইমরান খান ‘অসদুপায় অবলম্বন’ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে।
মোহসিন নেওয়াজ বলেন, ইমরান খান তাঁর ২০১৮–২০১৯ সালের সম্পদের বিবরণীতে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দেওয়া কয়েকটি ঘড়ির তথ্য গোপন করেছিলেন। পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী এটি একটি অপরাধ।
অবশ্য মামলার শুনানিতে ইমরান খানের আইনজীবী বলেছিলেন, নিয়ম মেনে তোশাখানা থেকে উপহার কিনেছিলেন ইমরান। বিষয়টি কর পরিশোধের রসিদে উল্লেখ করা হয়েছে এবং কমিশনকে জানানো হয়েছে।
শুনানিতে উপহার কেনার অর্থের উৎস সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন ইসিপি প্যানেলের সদস্যরা। জবাবে ইমরান খানের আইনজীবী বলেন, তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য কমিশনকে দেবেন না।
নির্বাচন কমিশনের রায়ে বলা হয়েছে, ইমরান খান ভুয়া হলফনামা দাখিল করেছেন। সংবিধানের ৬৩ (১) (পি) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি ‘দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন’ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন পিটিআই নেতারা। তাঁরা জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কমিশনের আদেশের পরপরই ইসলামাবাদ, লাহোর, পেশোয়ার, ফয়সালাবাদ ও করাচিতে বিক্ষোভ শুরু করেন পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীরা।
ইসিপির ঘোষণার পর ইসলামাবাদে ইমরানের সমর্থকেরা বিক্ষোভ ও গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ সময় তাঁর এক নিরাপত্তারক্ষীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।