বিশ্লেষণ

পাকিস্তানের সামনে এখন কী

শাহবাজ শরিফ (ওপরে বামে), ইমরান খান, বিলাওয়াল ভুট্টো (নিচে বামে), আসিম মুনির
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ ৯ আগস্ট ভেঙে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। জাতীয় পরিষদ বিলুপ্তির ধারাবাহিকতায় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার লক্ষ্যে ১২ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের নাম ঘোষণা করা হয়।

পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ায় ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হতে হবে। অর্থাৎ, নিয়ম অনুসারে, দেশটিতে আগামী নভেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা।

তবে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের জেরে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিসহ পরবর্তী কয়েক মাসে দেশটিতে কী হতে পারে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে আল-জাজিরা।

তত্ত্বাবধায়ক–প্রধানের নাম ঘোষণা

আনোয়ারুল হক কাকার

পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেলুচিস্তান আওয়ামি পার্টির (বিএপি) নেতা আনোয়ারুল হক কাকারের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও জাতীয় পরিষদের বিদায়ী বিরোধীদলীয় নেতা রাজা রিয়াজ গতকাল কাকারের নাম ঘোষণা করেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) জোট সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল বিএপি। তবে গত বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। গত বছরের এপ্রিলে বিরোধীদের অনাস্থা ভোটে ইমরানের সরকার ক্ষমতা হারায়। এই অনাস্থা ভোটে ইমরান-বিরোধীদের সমর্থন দিয়েছিল বিএপি।

পাকিস্তানের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার প্রদেশ বেলুচিস্তানের একজন স্বল্পপরিচিত সিনেটর কাকার। তাঁর নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই পাকিস্তানের আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব তাঁর।

নির্বাচন কি বিলম্বিত হবে

নিয়ম অনুসারে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবশ্যই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।

তবে বিদায়ী সরকার তার মেয়াদের শেষ দিকে একটি নতুন আদমশুমারি অনুমোদন করে। ফলে নির্বাচন কমিশনকে নতুন নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।

কমিশনের একজন সাবেক কর্মকর্তার মতে, শত শত ফেডারেল ও প্রাদেশিক নির্বাচনী আসনের জন্য নতুন সীমানা তৈরিতে কমপক্ষে ছয় মাস বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।

কাজটি শেষ করতে ঠিক কত সময় লাগবে, তা নির্বাচন কমিশনকে ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচনী এলাকার নতুন গঠন নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ দিতে হবে।

সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কী

পাকিস্তানে পর্দার আড়ালে দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বয়স ৭৬ বছর। এর মধ্যে তিন দশকের বেশি সময় দেশটি সরাসরি শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। দেশটির রাজনীতির ওপরও সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তার সাংবিধানিক সময়সীমার চেয়ে প্রসারিত হয়, তাহলে পাকিস্তান একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া দীর্ঘদিন পরিচালিত হওয়ার পরিস্থিতিতে পড়বে। বিষয়টি পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে তার নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত করার সুযোগ তৈরি করে দেবে।

প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কারা

পাকিস্তানে পরবর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল রয়েছে তিনটি। এগুলো হলো পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), পাকিস্তান মুসলিম লিগ, নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।

রাষ্ট্রীয় উপহার কেনাবেচা–সংক্রান্ত (তোশাখানা) দুর্নীতি মামলায় সম্প্রতি পিটিআই চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। সাজা ঘোষণার পরই ইমরানকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এই সাজার পর ইমরানকে নির্বাচনে পাঁচ বছরের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ক্ষোভ ও সহানুভূতি ভোটে কাজে আসবে বলে আশা করছে পিটিআই।

পিটিআইয়ের ধারণা, ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটির জয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবার। তবে দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পিটিআইয়ের তিক্ত সম্পর্ক চলছে। ফলে জেনারেলদের সঙ্গে পিটিআইয়ের বৈরিতার অবসানের ওপর নির্ভর করবে দলটির সম্ভাবনা। তবে এমন কিছু ঘটা এখন পর্যন্ত অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।

পিএমএল-এনের সুপ্রিমো নওয়াজ শরিফ। তিনি পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর ছোট ভাই শাহবাজ। তাঁর নেতৃত্বাধীন বিদায়ী জোট সরকারের প্রধান অংশীদার পিএমএল-এন। নওয়াজ অনেক দিন ধরে স্বেচ্ছানির্বাসনে লন্ডনে অবস্থান করছেন। নির্বাসন থেকে তিনি দেশে ফিরতে চান। তবে দেশে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার সাজা বহাল রয়েছে। ফলে শাহবাজ ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন।

পিপিপির তরুণ চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি (৩৪)। তিনি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে। তিনি বিদায়ী জোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে আলোচিত হন। তাঁকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নানা চ্যালেঞ্জ

পাকিস্তান বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে (বেলআউট) পাকিস্তানের জন্য ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বর্তমানে পাকিস্তানের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা।

বর্তমানে পাকিস্তানের আরেকটি বড় সংকট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে ইমরানকে কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানোসহ তাঁকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করার পর দেশটির রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। গত মে মাসে তাঁকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা হয়। তবে এবার কোনো সহিংসতা হয়নি। কিন্তু তাঁকে কারাগারে রেখে, তাঁকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করা হলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

যদি পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হয়, তাহলে সাংবিধানিক ও আইনগত নানা প্রশ্ন সামনে আসবে। সাংবিধানিক প্রশ্ন উঠলে তার সুরাহায় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের ইতিহাস রয়েছে।