কারাবন্দী পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানের প্রতি অনুগত থাকা রাজনীতিকেরা দেশটির সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করেছেন।
৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে ইমরান-অনুগত রাজনীতিবিদেরা রাজনৈতিকভাবে প্রতাপশালী প্রার্থীদের হারিয়ে জয়ী হয়েছেন। ইমরানের এই অনুগত রাজনীতিবিদদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিও আছেন, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে আনকোরা।
ইমরানের অনুগত রাজনীতিবিদেরা যেখানে বিজয়ী হয়েছেন, সেখানে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা রাজনীতিকেরা দেশটির শক্তিশালী চক্রের সমর্থন নিয়েও অপমানজনক পরাজয়ের শিকার হয়েছেন।
গত বছরের ৯ মে দুর্নীতির এক মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার জেরে সেদিন দেশব্যাপী জাতীয় নিরাপত্তা স্থাপনাগুলোয় হামলা হয়। এই হামলার কারণে পিটিআই রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়ে।
ইমরানের দলকে আক্ষরিক অর্থেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে মুছে ফেলতে সব চেষ্টা করা হয়।
দলটির শীর্ষ নেতাসহ অনেক কর্মীকে কারাগারে পোরা হয়। আনুগত্য পরিবর্তন বা রাজনীতি ছেড়ে দিতে তাঁদের ওপর চাপ দেওয়া হয়। গণমাধ্যমের খবর থেকে তাঁদের উধাও করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় ইমরানের প্রতি অনুগত থাকা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
কঠিন সময়ে ইমরানকে ত্যাগ করা খ্যাতনামা রাজনীতিকদের মধ্যে পারভেজ খট্টক অন্যতম। তিনি খাইবার পাখতুনখাওয়ার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী।
ইমরানের দল ছেড়ে খট্টক পিটিআই-পার্লামেন্টারিয়ান (পিটিআই-পি) নামের একটি দল গঠন করেন।
চিনি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক জাহাঙ্গীর তারিন একসময় ইমরানের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনিও পিটিআই ছাড়েন। গঠন করেন ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টি (আইপিপি)। স্পষ্টতই ক্ষমতাশালী চক্রের ইশারায় পিটিআই ত্যাগীদের দলে ভেড়াতে তিনি এই কাজ করেন।
তবে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পিটিআই-পি ও আইপিপি উভয় দল অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারের সময় খট্টক জোরগলায় দাবি করেছিলেন যে তিনি খাইবার পাখতুনখাওয়ার (কে-পি) পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হবেন। আর পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও জয়ের পর তাঁর সঙ্গে জোট করবেন।
অন্যদিকে তারিনের অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। তাঁর আইপিপি নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সঙ্গে আসন–সমঝোতা চুক্তি পর্যন্ত করে। তারিন দাবি করেন, তাঁরা একত্রে কেন্দ্র ও পাঞ্জাবে সরকার গঠন করবেন।
তবে তারিনের দল লাহোর থেকে জাতীয় পরিষদের মাত্র দুটি আসন পাচ্ছে। এর একটি আলিম খানের, অন্যটি আওন চৌধুরীর।
তবে উভয়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তাঁদের নির্বাচনী জয়কে চ্যালেঞ্জ করছেন।
পরিহাসের বিষয় হলো, খট্টক ও তারিন উভয়ে তাঁদের নিজ নিজ আসনে হেরে গেছেন।
নির্বাচনে পিটিআই-পি আক্ষরিক অর্থেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খট্টকের দুই ছেলে ও এক জামাতা খাইবার পাখতুনখাওয়ার নওশেরার সাতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তাঁরা কোনো আসনে জিততে পারেননি। পিটিআই-সমর্থিত একজন তরুণ নবিশ রাজনীতিক তাঁদের বড় ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, কেন পাকিস্তানি ভোটাররা খট্টক ও তারিনের মতো রাজনৈতিক ওজনদার প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করলেন?
পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক লায়েক আলী খান বিবিসি উর্দুকে বলেন, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় যে দলগুলো ইমরানের সমালোচনা করেছিল, সেগুলোকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁদের আসন এক বা দুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, দলছুট খট্টক অপমানজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছেন।
খট্টক নির্বাচনী প্রচারের সময়ই জনসাধারণের কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন। লোকজন খট্টকের সভা-সমাবেশে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আলী আকবর বিবিসি উর্দুকে বলেন, নির্বাচনী প্রচারের সময় খট্টকের নিজের ওপর এতটাই আস্থা ছিল যে তিনি নিজেকে ভবিষ্যতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রতিনিয়ত উপস্থাপন করছিলেন। নির্বাচনে গোহারা হারের পর তাঁকে জনগণের শক্তি ছাড়া অন্য কারও ওপর নির্ভর না করার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
খট্টকের দলের আরেক বড় মুখ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাহমুদ খান। তিনি দুটি নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। দুটিতেই হেরেছেন তিনি।
সাংবাদিক আলী আকবরের মতে, এই নির্বাচনে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে জনগণ স্বাধীনভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছে। ফলাফলে প্রমাণিত হয়, এই প্রার্থীরা ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানের জন্যই জয় পেয়েছিলেন, ব্যক্তিগত কৃতিত্বের কারণে নয়।
তা ছাড়া ইমরানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে এই রাজনীতিকদের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ছিল। ভোটাররা তাঁদের এই ক্ষোভের প্রতিফলন ভোটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ইরফান খান মনে করেন, পাকিস্তানে ইমরানের প্রতি মানুষের ব্যাপক ভালোবাসা আছে। খট্টক ও মাহমুদ প্রাদেশিক সরকারে বড় পদে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের জনপ্রিয়তা–কৃতিত্ব ইমরানের নীতি ও জনতুষ্টিবাদে চাপা পড়ে গেছে।
ইমরান ও তাঁর দল যখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি, তখন শুধু খাইবার পাখতুনখাওয়ায় রাজনীতিবিদেরাই পিটিআই ছাড়েননি, পাঞ্জাবের কিছু রাজনৈতিক ওজনদার ব্যক্তি নিজস্ব দল গঠনের জন্য ইমরানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
তারিনের আইপিপি জাতীয় পরিষদের ১২টি আসনে এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদের ৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দলটি পিএম-এনের সঙ্গে আসন-সমঝোতা চুক্তি করে।
ফলাফল দেখা যাচ্ছে, আইপিপি মাত্র দুটি আসন পাচ্ছে। এর মধ্যে অবশ্য একটি আসনের ফলাফলের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন লাহোর হাইকোর্ট।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের ফলাফল সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। সব বিশ্লেষণকেই ভুল প্রমাণ করেছে নির্বাচনের ফলাফল। ইমরান ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর কাহিনি শুধু খাইবার পাখতুনখাওয়াকেই নয়, পাঞ্জাবকেও অনুরণিত করেছে। এ কারণে পাঞ্জাবে আইপিপি বা খাইবার পাখতুনখাওয়ায় খট্টকের দল কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি।