‘ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির’ মাশুল দিলেন কি ইমরান খান

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান
ছবি এএফপি

ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বিষয়টি আকস্মিক মনে হতে পারে। ৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল খুব বেশি সময় নয়। বলা যায়, ৮ মার্চ বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব আনার সময়ও কেউ ভাবেনি ইমরানের বিদায় নিশ্চিত। তবে এমন পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। ইমরানের বিদায়ের পেছনে দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বড় ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু অনাস্থা প্রস্তাব ঘিরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের’ বিষয়টি। কার্যত একটি ‘ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি’ গ্রহণ করতে গিয়ে চড়া মাশুল দিলেন ইমরান খান, যেটাকে তিনি ‘স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি’ বলে আসছিলেন।

সরকার উৎখাতে অনাস্থা প্রস্তাব ঘিরে শুরুতে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কথা সামনে আনেন ইমরান খান নিজেই। প্রথমে কিছুটা রাখঢাক করলেও একপর্যায়ে ‘মুখ ফসকে’ যুক্তরাষ্ট্রের নাম বলে ফেলেন ইমরান। এরপর বিষয়টি আর গোপন থাকেনি। তার সরকারকে উৎখাতের চেষ্টায় প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দিতে থাকেন তাঁর দলের নেতারাও। তবে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি অস্বীকার করে। ইমরানের দাবি, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সমালোচনায় সংযমী হওয়ায় এবং হামলার দিন মস্কো সফর ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করায় নাখোশ হয় যুক্তরাষ্ট্র। কূটনীতিক তারবার্তার বরাত দিয়ে পাকিস্তানের সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ক্ষমতায় থাকলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব পড়বে বলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে হুমকি দিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা। অনাস্থা প্রস্তাবের গোটা বিষয়টির সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে। অবশ্য বিশ্লেষকেরা তাঁর দাবিকে ‘অতিরঞ্জন’ বলছেন।

ইসলামাবাদে এক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে পাকিস্তানের সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির মতো কৌশলগত বিষয় যে দেশটির ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ হিসেবে পরিচিত সামরিক বাহিনী ঠিক করে দেয়, এ বিষয়ে দ্বিমত করার মতো বিশ্লেষক কমই আছেন। তাই ইমরানের মস্কো সফর যে সামরিক বাহিনীর পরিকল্পনা অনুযায়ীই হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য তোপে পড়া ইমরান খান নিজেই পরে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। মূলত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোভিয়েত আমলের মিত্র ভারত ক্রমে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকতে থাকলে পাকিস্তানকে হাতে রাখার কৌশল নেয় মস্কো। এরই ধারাবাহিকতায় দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা গতি পায়। পাকিস্তান ও রাশিয়ার সেনাবাহিনী যৌথ সামরিক মহড়ায়ও অংশ নেয়, যা একসময় চিন্তাও করা যেত না। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা চাপে ভারত নতজানু অবস্থান নিতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই হয়তো পুতিন ইমরানকে পাশে বসিয়ে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।

রুশ অস্ত্রের বড় আমদানিকারক ভারতও পুরোনো মিত্রের বার্তা বুঝতে ভুল করেনি। জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকার মতো এ সময়ের জন্য কঠিন পশ্চিমা চাপও সামাল দিয়েছে। পশ্চিমা অবরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে ছাড়ে তেল আমদানির সিদ্ধান্তেও অটল রয়েছে। এ জন্য অবশ্য বাহবা পেয়েছে ভারত। একেবারে নয়াদিল্লি ঘুরে গিয়ে পুরোনো বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। কিন্তু বিপদে পড়েছেন ইমরান খান। এই অঙ্কে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি দেখতে পেয়ে ‘ইউটার্ন’ নিয়েছে সামরিক বাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বলে বসলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকার পরও ছোট একটি দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন ক্ষমা করা যায় না।’ তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। এরপর ইমরানের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। আফগানিস্তান ইস্যুতে এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছে, চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেঁকে বসলে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়বে পাকিস্তানও। মিলবে না আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বৈশ্বিক আর্থিক সংস্থার সাহায্য। তাই এই যাত্রায় ইমরান খানকে ‘বলি দেওয়াই শ্রেয়তর’।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মস্কো সফরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে করমর্দন করছেন পাকিস্তানের সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

ইমরান খান ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কে টান পড়ে পাকিস্তানের। সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে ২০১৪ সালে ইয়েমেনের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায় ইসলামাবাদ। তখন ক্ষমতায় ছিলেন নওয়াজ শরিফ। তাঁকে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র মনে করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণের আগে তাঁর নির্বাসিত দিনগুলো সৌদিতেই কেটেছিল। তাই রাজকীয় এই অতিথির কাছ থেকে এমনটা কোনোভাবেই আশা করেনি সৌদি আরব। এরপর ২০১৭ সালে যখন কাতারকে একঘরে করে ফেলে সৌদি-আমিরাত নেতৃত্বাধীন আরব জোট, তখনো নিরপেক্ষ অবস্থান নেয় পাকিস্তান। ২০১৮ সালে ইমরান খানের কাছে ক্ষমতা খুইয়ে হয়তো তার মাশুল দিয়েছিলেন নওয়াজ। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত নওয়াজ তাই সৌদি না গিয়ে এবার চিকিৎসার নামে লন্ডনে অবস্থান করছেন। ইমরানের আমলে চেষ্টা করেও সৌদি-আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক আগের জায়গায় নিতে পারেনি পাকিস্তান। সৌদির ‘ডি-ফ্যাক্টো শাসক’ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ইসলামাবাদে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েও সম্পর্কের উষ্ণতা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি ইমরান। তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আর কাশ্মীর ইস্যুতে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) গা–ছাড়া ভাব এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে ওঠে।

তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক কৌশলগত। অর্থনীতির চেয়েও এ সম্পর্কের সামরিক গুরুত্ব অনেক বেশি। পাকিস্তান তার সমরাস্ত্র সংগ্রহের নির্ভরতা চীনের ওপর থেকে কমানোর পথে হাঁটছে। এ ক্ষেত্রে দেশটির সামনে বলতে গেলে একমাত্র বিকল্প তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আমলে তুরস্কে সামরিক শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। তাই ন্যাটো মানের অস্ত্র পেতে পাকিস্তানের বিশ্বস্ত উৎস এখন আঙ্কারা। যুদ্ধজাহাজ থেকে ড্রোন-তুরস্কের আধুনিক সমরাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ পাকিস্তানের। এসব অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরেও উদার তুরস্ক। এ ছাড়া নিজেদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি সমৃদ্ধ করতে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে চায় আঙ্কারা। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক পারস্পরিক লাভের হিসাবেই। তবে তুরস্কের কাছে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে এই সম্পর্ককে কখনোই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি সৌদি আরব। ইসলামাবাদকে বাগে আনতে তাই বিনা সুদের ঋণের অর্থ ফেরত নেওয়াসহ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিতেও পিছপা হয়নি সৌদি রাজ। এ ছাড়া কাতারকে শায়েস্তা করতে গিয়েও পাকিস্তানকে পাশে পায়নি সৌদি-আমিরাত। বরং পাকিস্তানের জ্বালানি ও আর্থিক সহযোগিতার বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্র এই ধনী দেশটি। দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কও আগের চেয়ে বেড়েছে।

সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে নামে, যখন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। ‘জম্মু ও কাশ্মীর’ এবং ‘লাদাখ’ নামে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয় রাজ্যটিকে। ভারতের এ পদক্ষেপের বিপক্ষে সরব হয় পাকিস্তান। ওআইসিকেও কাশ্মীর ইস্যুতে কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানায় দেশটি। ওআইসির সভাপতির দায়িত্বে তখন সৌদি আরব। কিন্তু ওআইসির ভূমিকায় হতাশ হয় ইসলামাবাদ। কারণ, ভারতের পদক্ষেপের পর এ নিয়ে ওআইসির দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। উল্টো ওই সময়ে ভারতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় সৌদি আরব ও আমিরাত।

ইসলামাবাদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দেওয়া লালগালিচা সংবর্ধনায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

এমন পরিস্থিতিতে ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেননি ইমরান খান। কাশ্মীর ইস্যুতে ওআইসির ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেন তিনি, যা কার্যত সৌদি আরবের বিপক্ষে যায়। অবশ্য এ সময় পাশে পান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে। জাতিসংঘের মতো ফোরামে তিনি কাশ্মীর ইস্যুতে কথা বলেন। ইমরানও অনেকটা এরদোয়ানের মতো জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি করে থাকেন। দুই নেতা বিশ্বমঞ্চে কাশ্মীর ও ইসলাম-ভীতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে একসুরে কথা বলে আসছেন। কাশ্মীর ইস্যুতে হতাশ ইমরান তখন এরদোয়ানের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা মুসলিম বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কুয়ালালামপুরে একটি বিশেষ সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে একমত হন।এতে কাতার ও ইরানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু এই উদ্যোগের বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সৌদি আরব। রিয়াদ এটাকে ওআইসির বিকল্প সংস্থা তৈরি পদক্ষেপ হিসেবে দেখে। সৌদি আরবের চাপে শেষ মুহূর্তে এই সম্মেলনে অংশ নিতে পারেননি খোদ ইমরান খান।

‘নয়া পাকিস্তানের’ ডাক দিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইমরান খান। জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে ‘নয়া ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতির’ চেষ্টাও হয়তো ছিল। সেটা যতটা না নিজের ক্ষমতার প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশি হয়তো ছিল দেশের প্রয়োজনে। তবে পাকিস্তানের মতো দেশের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সেটা যে এতটা সহজ নয়, সাড়ে তিন বছরেই ক্ষমতা হারিয়ে সেটা প্রমাণ করেছেন ইমরান খান। যদিও সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে এর আগে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি, তবে এই প্রথম অনাস্থা ভোটে কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিদায় ভিন্ন বার্তাই দিচ্ছে।