ইন্টার–সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) মহাপরিচালক নিয়োগ নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আইএসআই প্রধান নিয়োগের ব্যাপারটি বরাবরই দেশটির আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। তবে সম্প্রতি আইএসআই মহাপরিচালক নিয়োগের বিষয় নিয়ে বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএসআই প্রধান নিয়োগের পদ্ধতি সংবিধান বা সামরিক আইনে উল্লেখ করা হয়নি। অতীতের সব নিয়োগ ঐতিহ্য অনুসারে করা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনটি নাম প্রস্তাব করেন। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে গত সপ্তাহে পাকিস্তানের সামরিক শাখা আইএসপিআর ঘোষণা দেয়, লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আহমেদকে নতুন আইএসআই প্রধান করা হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিডিয়া উইং থেকে তাঁকে ডিজি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য নামও ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে নিয়োগ দেওয়ার ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বার্তা আসেনি। এ নিয়ে নানা বিতর্ক হয় ও হচ্ছে। তার মধ্যে এ ইস্যুতে প্রথমবার পাকিস্তান সরকারের একজন মন্ত্রী বক্তব্য দেন। এরপরই শুরু হয় বিতর্ক।
২০ বছর পর গত আগস্টে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। এরপর আফগানিস্তানে নতুন সরকার গঠন নিয়ে তালেবান যখন জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সে সময় আকস্মিক কাবুলে গিয়েছিলেন আইএসআইয়ের প্রধান ফাইজ হামিদ। সেখানে তিনি বলেন, সব সমস্যার সমাধান করা হবে। তাঁর ওই সফরের কয়েক দিনের মধ্যে তুলনামূলক রক্ষণশীল নেতাদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করে তালেবান। এরপর ফাইজ হামিদের বদলে নাদিম আহমেদকে দেশটির প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের মহাপরিচালক পদে আনার কথা জানানো হয়।
বিতর্কের মধ্যেও জেনে নেওয়া যাক আসলে কোন প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের গুরুকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ডনের সাংবাদিক উরুহ ইমরান ও সানা চৌধুরী সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জানান, তিনি চান বর্তমান প্রধান লে. জেনারেল ফাইজ হামিদ আরও কিছুদিন দায়িত্ব চালিয়ে যান। আর তাঁর এ চাওয়ার কারণ হলো আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি।
এ সবকিছুর মধ্যে বর্তমানে কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে। কীভাবে আসলে আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ দেওয়া হয়। আসলে কে আইএসআই মহাপরিচালক নিয়োগ দেন, মহাপরিচালক কার কাছে রিপোর্ট করবেন, আইএসআইয়ের প্রধান কি বেসামরিক কেউ হতে পারবেন?
বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত, অতীতের নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ার নথি ঘেঁটে বিশ্লেষকেরা বলেন, আসলে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগে শতসিদ্ধ কোনো নিয়ম বা প্রক্রিয়ার কথা তাঁরা চেষ্টা করেও জানতে পারেননি। অন্তত কোনো প্রকাশ্য লিখিত ডকুমেন্টও তাঁরা পাননি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর হাতে নতুন আইএসআই মহাপরিচালক পদের প্রার্থীদের নাম এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া সম্প্রতি বৈঠক করেন। এ বৈঠকের বিবরণ প্রকাশের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) জাতীয় পরিষদের চিফ হুইপ আমির ডোগারকে তিরস্কার করেছেন। তিনি দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশও পেয়েছেন।
ডনের আবাসিক সম্পাদক ফাদ হুসেন বলেন, আমির ডোগার আসলে প্রক্রিয়াটি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, আমির ডোগার ব্যাখ্যা করেন, তিনটি নাম প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের হাতে আছে। এখান থেকে তিনি সম্ভাব্য যোগ্য একজনকেই বেছে নেবেন। আইএসআই নানা কাজে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে আর তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের নামটি আসে।
ডনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ বাকিরও বলেন, আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগের কোনো সাধারণ প্রক্রিয়া নেই। সেনাপ্রধান এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে কথা বলেন। সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেরাদের নামগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যখন সেরা দুজনের মধ্য একজনকে বেছে নিতে হয়, তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠান আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগের ব্যাপারে।
সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ হুসেইন ডনকে বলেন, আইএসআইয়ে কোনো কর্মকর্তার বদলি বা পদায়নের ক্ষমতা সেনাপ্রধানের হাতে থাকলেও সাধারণ চর্চা হচ্ছে যে গোয়েন্দাদের প্রধান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। কারণ, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করেন। আইএসআইয়ের প্রধান কে হবেন, তা হয়তো প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেনাপ্রধান আবার আইএসআইয়ের প্রধানসহ যে কারও বদলি ও পদায়ন করে থাকেন। তিনি জানান, ফাইজ হামিদের বদলির সিদ্ধান্ত সেই নিয়ম মেনে হয়েছে। তাই ইমরান খানের ইচ্ছায় আইএসআইয়ে প্রধান হিসেবে ফাইজ হামিদের থাকার আর কোনো অধিকার নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, আইএসআই প্রধানের পদে একজন বেসামরিক লোক নিয়োগে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই বা কোনো বিধিনিষেধ নেই। গোয়েন্দা সংস্থায় কতজন সামরিক এবং কতজন বেসামরিক লোক থাকবে, নিয়োগ বা পদায়ন করা হবে তারও কোনো শতসিদ্ধ নিয়ম নেই।
জাহিদ হুসেইন জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো অবসরে যাওয়া জেনারেল শামসুর রহমানকে আইএসআইয়ের প্রধান করেছিলেন। তিনি বেশি দিন সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। শামসুর রহমান নিয়োগের সময় বেসামরিক ব্যক্তিই ছিলেন।
সাঈদ বাকির জানান, বেসামরিক ব্যক্তির গোয়েন্দাদের প্রধান হওয়ার পথে কোনো বাধা নেই।
অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল শাহজাদ চৌধুরী সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেন, আইএসআই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানতে বাধ্য। কিন্তু সেখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা সেনাপ্রধানের নির্দেশনা মানেন। এর অর্থ দাঁড়াল প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএসআই প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করে। আবার এটাও ঠিক যে প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির ওপরও মহাপরিচালকের পদে বেশি দিন থাকা না থাকা নির্ভর করে।
মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে মঙ্গলবার তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, গোয়েন্দাদের নতুন প্রধান নিয়োগের জন্য আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতামত থেকে এটা স্পষ্ট যে আসলে এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই।
এর আগে মঙ্গলবার তথ্যমন্ত্রী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নতুন আইএসআই প্রধানকে নিয়োগ দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ করা হবে। আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আমরা এ উপসংহারে আসতে পারি যে আইনি প্রক্রিয়াটি এখন অনুসরণ করা হবে’। তিনি প্রশ্ন তোলেন, আগে কি আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি?
সাঈদ বাকির যোগ করেন, এ নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত কথা বলতে হবে না। তবে, আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগের জন্য তাঁর সম্মতি প্রয়োজন। আইএসআই প্রধান নিয়োগ পদ্ধতির জন্য লিখিত কোনো আইন আছে বলে তিনি জানেন না। তিনি এমন কিছু দেখেননি।
আইএসআইয়ের প্রধান কীভাবে নিয়োগ হয়, এটা নিয়ে বিতর্ক প্রথমবার হচ্ছে, ব্যাপারটি এমন নয়। সুনির্দিষ্ট নিয়মের অভাবে সশস্ত্র বাহিনীর পেস্টিং এবং নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে অস্পষ্টতা আছে।
২০১৯ সালের আগস্টে জেনারেল বাজওয়াকে সেনাপ্রধান হিসেবে মেয়াদ শেষের তিন মাস আগেই তাঁর মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। প্রায় এক দশকে দ্বিতীয়বারের মতো দেশের শীর্ষ জেনারেলের মেয়াদ এভাবে বাড়ানো হয়েছিল। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত সাময়িকভাবে জেনারেল বাজওয়াকে সেনাপ্রধান পদে থাকার অনুমতি দিয়েছিল। তখন আদালত পার্লামেন্টে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিল।
এরপর পাকিস্তানের পার্লামেন্ট তিনটি বিল পাস করেছে। সেই বিলে অনেক দিনের দীর্ঘ এবং বিতর্কিত নানা সমস্যার অবসান হয়। এ তিন বিলের ফলে প্রধানমন্ত্রীর সেনাপ্রধান, জয়েন্ট স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যানসহ কয়েক পদে নিয়োগ এবং মেয়াদ বাড়ানোর পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।
তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী জানান, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান মিলে আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগের আলোচনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছেন। নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। তথ্যমন্ত্রীর মতে, বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্ব আবারও প্রমাণ করেছে যে দেশের স্থিতিশীলতা, অখণ্ডতা এবং অগ্রগতির জন্য সব ঐক্যবদ্ধ।
তবে নানা বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনার পরে রাজনৈতিক মহলে যাঁরা আছেন, তাঁরা এখন আইএসআইয়ের নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তির অপেক্ষায় আছেন।