পাকিস্তান আরও একবার নজিরবিহীন সাংবিধানিক সংকটে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর আনা অনাস্থা প্রস্তাব জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে নাকচ করে দিলে রাজনৈতিক সংকট গড়ায় সাংবিধানিক সংকটে। জাতীয় পরিষদের ৩৪২ সদস্যের ওপর স্পিকারের এমন হস্তক্ষেপ এবং তাঁর ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়া নজিরবিহীন বলছেন দেশটির আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী জিবরান নাসির। চলমান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট নিয়ে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডনে লেখা তাঁর মতামতটি ছিল এমনই।
গত রোববার জাতীয় পরিষদে ডেপুটি স্পিকারের কর্মকাণ্ডে হয়তো এই যাত্রায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হটাতে বিরোধীদের প্রচেষ্টা ঠেকানো গেছে। কিন্তু তাঁর এই কর্মকাণ্ড দেশকে আরেকটি সাংবিধানিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। সংসদীয় শক্তি—সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ ও যোগাযোগ পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়ার বিষয়টি এখন প্রকাশ্য। সমস্যাটা হলো বিচারব্যবস্থাকে আবারও রাজনীতিতে টেনে আনা। সংসদীয় কার্যক্রম এখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ।
আদালত হয়তো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থার বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ প্রয়োগে এবং ইতিমধ্যে রুল ৩৭–এর আওতায় ও জাতীয় পরিষদের রুলস অব বিজনসের দ্বিতীয় তফসিল অনুযায়ী স্পিকারকে দেওয়া ক্ষমতায় ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ নেই বলে আদেশ দিতে পারেন। বিপরীতে অনাস্থা প্রস্তাব খারিজে স্পিকারের ক্ষমতা আছে বলেও আদেশ দিতে পারেন আদালত।
রোববারের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের কয়েক ঘণ্টা পর সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) শুনানি শুরু করেন। জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দেওয়া সব আদেশ ও কর্মকাণ্ড আদালতের সিদ্ধান্তের অধীন আসবে বলে ইতিমধ্যে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ প্রয়োগ এবং জাতীয় পরিষদে আগে থেকে উত্থাপিত একটি প্রস্তাব স্পিকারের খারিজ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সংবিধানসম্মত কি না, এই প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেলের সাহায্য চেয়েছেন আদালত। স্পিকারের অনুচ্ছেদ ৫–এর ব্যাখ্যা প্রদান এবং তিনি নিজ বিচারবোধ থেকে তা প্রয়োগ করতে পারেন কি না, সোমবার এ বিষয়ে বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল বলেছেন, যদি স্পিকার জাতীয় পরিষদে অনুচ্ছেদ ৫–এর বিষয়টি উল্লেখ করেও থাকেন, তিনি অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করতে পারেন না। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে আদেশ দেওয়ার কথা রয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৫(১)–এ রাষ্ট্রের আনুগত্যের মানদণ্ডের বিষয়ে বলা হয়েছে আর অনুচ্ছেদ ৫(২)–এ এই আনুগত্যের বিষয়ে করণীয়–বর্জনীয় নিয়ে বিস্তারিত বলা আছে। পরের উপধারায় সব নাগরিকের, বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা এবং যাঁদের ভূমিকা সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনুচ্ছেদ ৫(১)–এ উল্লেখিত আনুগত্যের বিষয়টি নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।
কোনো প্রস্তাবে ভোট প্রদানসহ জাতীয় পরিষদের সদস্যদের মতো স্পিকারের ভূমিকা ও ক্ষমতাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যদি স্পিকার দেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করতে চাইতেন, তাহলে তাঁর সাংবিধানিক ম্যান্ডেট মেনে চলা উচিত ছিল। অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটির বিতর্কে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) মতামতের ওপর আলোচনার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। আর হুমকির চিঠির বিষয়টি এবং সরকারের উদ্বেগ সম্পর্কে তিনি জাতীয় পরিষদের সব সম্মানিত সদস্যকে তা অবগত করানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পারতেন।
সরকারি দলের দেওয়া যুক্তির পরও বিরোধী দলের সদস্যদের সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে, তাঁরা যেভাবে উপযুক্ত মনে করবেন, সেভাবে এই প্রস্তাবে ভোট দেওয়ার। কিন্তু স্পিকার জাতীয় পরিষদের সদস্যদের ভোট দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়েছেন এবং অনুচ্ছেদ ৫(২) লঙ্ঘন করেছেন।
মূলত বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা বলে যখন স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দেন, তার মানে গত ৮ মার্চ জাতীয় পরিষদে আনা ৮৬ আইনপ্রণেতাকে তিনি অভিযুক্ত করছেন। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ায় এখন কি অবশ্যই জাতীয় পরিষদে তাঁদের অযোগ্য ঘোষণার মুখোমুখি হতে হবে?
মজার বিষয় জাতীয় পরিষদের রোববারের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির দেওয়া মতামতের ওপর নির্ভর করে। অথচ তারা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অনাস্থা ভোটের বিষয়ে কোনো কিছুই বলেনি। এতে শুধু বলা হয়েছে, প্রাপ্ত যোগাযোগ তথা কূটনৈতিক তারবার্তায় যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি বিদেশি শক্তির নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, পার্লামেন্টের সব আইনপ্রণেতাকে নিয়ে কূটনৈতিক তারবার্তার বিষয়ে রুদ্ধদ্বার অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই অধিবেশন ডাকা হয়নি।
তদুপরি পুরো প্রক্রিয়াটি সাজানোর যে ধরন, তাতে মনে হয়, আইনসভার প্রতিনিধিত্ব করার পরিবর্তে স্পিকারের কার্যালয় ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাহী বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং সরকারের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছেন। নবনিযুক্ত ফেডারেল আইনমন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন এবং রুলিং দাবি করলেন। কোনো ধরনের সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার সময় না নিয়ে স্পিকার আগে থেকে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনালেন।
আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে স্পিকারকে নির্দলীয় ধরে নেওয়া হয়। তিনি আইন বিভাগের প্রতিনিধি, নির্বাহী বিভাগের নন। হাউসের অভিভাবক হিসেবে তাঁর কাজ হলো যেকোনো প্রস্তাবের ওপর বিতর্কের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রেও তা করা হয়েছিল। বিতর্কের বিষয় শুনে আইনপ্রণেতারা তাঁদের বিচারবোধ প্রয়োগ করবেন এবং প্রস্তাবের পক্ষে–বিপক্ষে ভোট দেবেন। কিন্তু স্পিকারের হস্তক্ষেপ এবং পরিষদের ৩৪২ জন সদস্যের ওপর তাঁর ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন।
১৯৮৯ সালে বেলুচিস্তান অ্যাসেম্বলিতেও (প্রাদেশিক পরিষদ) একই ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া মুখ্যমন্ত্রীর (চিফ মিনিস্টার) পরামর্শে অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেন গভর্নর। পরে আদালত হস্তক্ষেপ করে। ভোটাভুটির ওপর জোর দেওয়া গভর্নরের উচিত ছিল বলে আদেশ দেন আদালত।
একইভাবে ২০১৭ সালের ইমরান খান বনাম মিয়া নওয়াজ শরিফের কুখ্যাত পানামা মামলার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, স্পিকারের দেওয়া নির্দিষ্ট কিছু আদেশ ন্যায়সংগত হতে পারে। যদি ‘স্পিকারের দেওয়া সিদ্ধান্ত আইনিভাবে এবং বাস্তবিকভাবে সঠিক নাও হয়’, তবে উপযুক্ত এখতিয়ার আছে, এমন আদালত তা ঠিক করে দিতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
চলমান ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে সংযম প্রদর্শন এবং অনুচ্ছেদ ৯৫–এর কার্যকারিতা বহাল রেখে সংবিধান যেভাবে আছে, কেবল তা প্রয়োগ করা। অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর রোববার যে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল, সে সময়ে ফিরে যাওয়া।
সংবিধানের মধ্যে থেকেই ব্যতিক্রম খুঁজে বের করার চেষ্টা অবশ্যই করা যাবে না। এতে সংবিধানের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী বিষয়ের সৃষ্টি করবে। অতীতে এমন ধরনের ব্যতিক্রম তৈরি করা হয়েছিল। এমনটি শুধু সুপ্রিম কোর্টের বৈধতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
যদি অ্যাসেম্বলি (পার্লামেন্ট) ভেঙে দেওয়া বৈধ সিদ্ধান্ত ধরে নেওয়া হয় এবং সুপ্রিম কোর্ট এটাকে এভাবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে এটা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজে স্পিকারের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেবে। অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিতে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও বাড়াবে। আরেকটি বিষয় হলো, এই কাজ করে প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে নাম চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতাকে কাজ শুরু করতে বলেছেন।
জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সময় অনুচ্ছেদ ২২৪ ও ২২৪(এ) দ্বারা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
তিন দিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা এবং প্রেসিডেন্টকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে একমত হতে হবে। যদি তাঁরা ব্যর্থ হন, জাতীয় পরিষদ ও সিনেটের আট সদস্য নিয়ে সংসদীয় কমিটি গঠন করবেন জাতীয় পরিষদের স্পিকার। সরকার ও বিরোধী দল থেকে সমানসংখ্যক সদস্য এ কমিটিতে থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা দুটি করে নাম সংসদীয় কমিটিতে প্রেরণ করবেন।
এই কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে মতামত দিতে হবে। যদি ব্যর্থ হন, নামগুলো পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হবে। তাদের দুই দিনের মধ্যে অবশ্যই একজনের নাম চূড়ান্ত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সময়ের হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে একজন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
যাহোক, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ডেপুটি স্পিকারের কর্মকাণ্ড চ্যালঞ্জ করেছে বিরোধীরা। তাদের কাছে এটা রাষ্ট্রদ্রোহের চেয়ে কম গুরুতর নয়। তাই তারা অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নসহ কোনো ধরনের সংলাপে অংশ নেবে বলে মনে হচ্ছে না।
এতে আবারও সাংবিধানিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে নাম প্রস্তাবের প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ডেকে আনবে। এখন সবার নজর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের ওপর। তাঁরা যেই সিদ্ধান্তই দিন, রোববার ডেপুটি স্পিকারের নেওয়া অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব কয়েক বছর না হলেও কয়েক মাস নিশ্চিতভাবে অনুভূত হবে।
এ সবকিছুর মধ্যে বড় ক্ষতিটা হয়ে গেল সংবিধানের; যাহোক, অন্তত প্রধানমন্ত্রী তো টিকে আছেন।