আল–জাজিরার বিশ্লেষণ

ইমরান খানের অপসারণ কেন চাইছেন বিরোধীরা

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তাঁর সরকারকে অপসারণের লক্ষ্যে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। এটি ২০১৮ সালের আগস্ট মাস থেকে ক্ষমতায় থাকা ইমরানের পুরো পেশাজীবনেই সবচেয়ে বড় এক রাজনৈতিক সংকট।

স্থানীয় সময় আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় রাজধানী ইসলামাবাদে পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টায় অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে পারে।

ইমরানকে অপসারণের এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রধান দুই বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ–নওয়াজ (পিএমএল–এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।

দুর্নীতির উচ্ছেদ ও দেশে রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা থেকে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা ইমরান খান। সম্প্রতি বিভিন্ন জনসভায় দেওয়া উত্তেজক ভাষণে তিনি তাঁর বিরোধীদের ‘চোরের দল’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। সেই সঙ্গে অনাস্থা ভোটে তাঁদের পরাজিত করার অঙ্গীকার করেন তিনি।

ইমরানের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরাও বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাব আনার পদক্ষেপের সময় ও তাঁদের মতলব নিয়ে সরাসরি আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। যেমন: পিটিআইয়ের পররাষ্ট্রবিষয়ক পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি আন্দালিব আব্বাস আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এগুলো সবই তাঁদের নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টামাত্র।’ পিএমএল–এনের নেতৃত্বদানকারী নওয়াজ শরিফ ও তাঁর ভাই এবং পিপিপির প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিকে উদ্দেশ করে এ কথা বলেন তিনি।

বিরোধীরা মনে করেন, ৩৪২ সদস্যের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে হারানোর মতো প্রয়োজনীয় শক্তি–সামর্থ্য রয়েছে তাঁদের। ইমরানকে অনাস্থা ভোটে হারাতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট।

আন্দালিব আব্বাস বলেন, ‘তাঁরা (বিরোধী দলগুলোর শীর্ষ নেতারা) জানেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁদের দুর্নীতিকে ছাড় দেবেন না ও তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনার জোর চেষ্টা চলছে।’

তবে আত্মবিশ্বাসী বিরোধী দলগুলো সরকারের দাবি নাকচ করে অনাস্থা ভোটে জেতার আশা করছে। প্রধানমন্ত্রীকে সরাতে আগ্রহী বিরোধীদলীয় নেতাদের একজন নাভিদ কামার। পার্লামেন্টারি নেতাদের অন্যতম পিপিপির এ জ্যেষ্ঠ নেতা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এই সরকারের কর্মক্ষমতা একেবারে নাজুক। প্রত্যেকেই তা প্রত্যক্ষ করছেন। বিশেষত, অর্থনীতিতে সরকারের অদক্ষতার ছাপ পড়ছে।’

নাভিদ কামার আরও বলেন, ‘তাঁকে (ইমরান) নিজ দলের সদস্যরাই পরিত্যাগ করবেন—এটি দেখা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। তাঁরা তাঁকে ঘৃণা করেন এবং এ সরকার কৃত্রিমভাবে বেঁচে রয়েছে।’

বিরোধীরা মনে করেন, ৩৪২ সদস্যের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে হারানোর মতো প্রয়োজনীয় শক্তি–সামর্থ্য রয়েছে তাঁদের। ইমরানকে অনাস্থা ভোটে হারাতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। ইমরানকে হটাতে পিটিআইয়ের ভিন্নমতাবলম্বী সদস্য ও ক্ষমতাসীন জোটের অসন্তুষ্ট সদস্যরা ভোটের সময় বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন।

ইতিমধ্যে পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীও ইমরানের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেবে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এই ধারণা বিরোধীদের আশাকে আরও জোরালো করছে।

অনাস্থা ভোট প্রসঙ্গে নাভিদ কামার বলেন, ‘যদি ইমরান খান ও জাতীয় পরিষদের স্পিকার নানা কূটকৌশল ও অপতৎপরতায় যুক্ত না হন, তবে দ্রুতই এ ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে।’

পার্লামেন্টে ইমরান খানের অবস্থান যে খুব পাকাপোক্ত নয়, সেটি পিটিআইয়ের ভিন্নমতাবলম্বী সাংসদ (এমএনএ) নুর আলম খানের বক্তব্যে ফুটে ওঠে। তাঁর দাবি, অনাস্থা প্রকাশে কমপক্ষে ২৪ জন ভিন্নমতাবলম্বী এমএনএ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন।

আল–জাজিরাকে নুর আলম বলেন, ‘জাতীয় পরিষদে ভোটাভুটিতে আমরা আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাব। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কী করতে পারেন, সেটি আমার জানা নেই। আমার মনে হয়, তাঁর যদি কিছু করার থাকে, তবে সে সময় শেষ হয়ে গেছে।’

ইমরান খান সরকারের প্রতি অসন্তোষের একগুচ্ছে কারণ উল্লেখ করেছেন পিটিআইয়ের এই সাংসদ। সেগুলো হলো অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তৃণমূল পর্যায়ের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতা। এ ছাড়া দলের ভেতর যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অতিসম্প্রতি ইমরানের দেওয়া আক্রমণাত্মক বক্তব্য অসন্তোষের আরেক কারণ।

প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে নুর আলম বলেন, ‘তিনি আমাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছেন। আমাদের ঘুষখোর বলে আখ্যা দিচ্ছেন। এটা অবিশ্বাস্য।’

পাকিস্তানি রাজনীতির অন্ধকার জগতে ইমরান এখনো বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হতে পারেন। নিজ দলের ভিন্নমতাবলম্বী সাংসদেরা তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিলে যাতে তা বৈধ না হয়, সে লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে সরকার। এ বিষয়ে আদালতের শুনানি চলছে। এ অবস্থায় অনাস্থা ভোট পিছিয়ে আগামী সপ্তাহে গড়াতে পারে।

অনাস্থা ভোটে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে এখন ইমরান ও বিরোধীদলীয় নেতারা—উভয় পক্ষ ক্ষমতাসীন জোটের দ্বারস্থ হচ্ছে। বিশেষ করে দুই পক্ষ নজর দিচ্ছে পাকিস্তান মুসলিম লিগ–কায়েদের (পিএমএলকিউ) সাংসদদের দিকে। দলটির নেতা পারভেজ এলাহি দীর্ঘদিন ধরেই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনরায় ফেরার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন ইমরান–সমর্থিত উসমান বাজদার।

পাঞ্জাব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল ও সমৃদ্ধ প্রদেশ। এখানকার মুখ্যমন্ত্রী যৌক্তিকভাবেই দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর বেসামরিক ব্যক্তি।

যাহোক, চূড়ান্তভাবে ইমরানের ভাগ্য নির্ভর করতে পারে দেশের সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গতি–প্রকৃতির ওপর। গত বছরের অক্টোবরে পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রধানকে অপসারণ করা নিয়ে ইমরান ও সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া কয়েক সপ্তাহ ধরে নজিরবিহীন মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ইমরান বাজওয়ার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ওই লড়াইয়ে হেরে যান। এর রেশ পড়তে পারে অনাস্থা ভোটে।

পিএমএলএনের জ্যেষ্ঠ সাংসদ খুররম দস্তগির বলেন, অনাস্থা ভোটে ইমরানের জয়–পরাজয়ের ভাগ্য নির্ধারণে দেশের লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে।