পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব তুলেছে বিরোধীরা। কাল রোববার অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি হওয়ার কথা। ভোটাভুটির আগে ইমরান খান গতকাল শুক্রবার বলেন, তাঁকে তিনটি উপায়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলেছে ‘এস্টাবলিশমেন্ট’। এগুলো হলো—অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া, পদত্যাগ করা অথবা আগাম নির্বাচন দেওয়া।পাকিস্তানের ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ মূলত দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী।
গতকাল বেসরকারি একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও তিনি পদত্যাগ করবেন না। তাঁকে ছেড়ে যেসব আইনপ্রণেতা বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, বিরোধীরা তাঁদের দিয়ে সরকার চালাতে পারবে না বলে দাবি করেছেন তিনি। ইমরান খান বলেন, তিনি পদত্যাগ বা নতুন সরকার গঠনের বদলে আগাম নির্বাচনের পক্ষে। আগাম নির্বাচন হলেই সবচেয়ে ভালো হবে বলে মনে করছেন তিনি।
ইমরান খান বলেন, ‘আমরা বলেছি, নির্বাচন হলো সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আমি পদত্যাগ করার কথা ভাবতেও পারি না। আমি শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে বিশ্বাস করি।’ দলত্যাগীদের নিয়ে সরকার চালানো যায় না দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি আগাম নির্বাচনের আয়োজন করি, তাহলে সেটাই পাকিস্তানের জন্য ভালো হবে।’
অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ইমরান বলেন, কাল যখন জাতীয় পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক হবে, তখন তিনি আরেকটি চমক নিয়ে আসবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একজন অধিনায়ক কখনো তার কৌশল কাউকে জানায় না। কিন্তু আমি আবার বলছি, এই অনাস্থা প্রস্তাব বড় একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।’
ইমরান খান বলেন, তাঁর জীবন এখন হুমকির মুখে। তিনি দাবি করেন, তাঁর সরকার পতনের ষড়যন্ত্র যাঁরা করছেন, তাঁরা এটা ভেবে ভয়ে আছেন, তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত হন তারপরও দেশের মানুষ তাঁকে সমর্থন করে যাবেন। ইমরান বলেন, ‘আমি এ কারণে প্রকাশ্যে এটা বলছি, আমার জীবন এখন হুমকির মুখে আছে।’
ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খান বলেন, ‘যাঁরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নিজেদের ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁরা এটা জানে যে আমি চুপ করে বসে থাকব না। তাঁরা কী ভাবছেন? তাঁরা দুই থেকে আড়াই হাজার রুপি খরচ করে আমার সরকার পতনের চেষ্টা করবেন আর আমি চুপ করে বসে থাকব? এ কারণে আমি প্রকাশ্যে এসব কথা বলছি।’
গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টাকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন ইমরান। এর প্রমাণ হিসেবে একটি হুমকিমূলক চিঠি পাওয়ার দাবি করেন তিনি। ওই ভাষণে চিঠির বিষয়ে বলতে গিয়ে ইমরান খান ‘মুখ ফসকে’ যুক্তরাষ্ট্রের নাম বলে দেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তা তিনি শুধরে নেন। পরে বলেন, একটি বিদেশি রাষ্ট্র হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে, যা পাকিস্তানবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র ইমরান খানের এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
প্রকাশ্যে সরকার পতনের চিঠির কথা বলার পর ইমরান খানকে হত্যার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেছেন তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী। গতকাল ইমরান খান তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা বলার কয়েক ঘণ্টা আগে ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে হত্যার চেষ্টা চলছে। ইমরান খান হত্যার হুমকিতে আছেন বলে তাঁদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আছে জানিয়ে ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘এ খবর পেয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।’
এ সপ্তাহের শুরুতে ইমরান খানের দল পিটিআইর নেতা ফয়সাল ভাওদাও একই অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ‘দেশ বিক্রি করতে’ অস্বীকার করায় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে ভাওদা বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একজন সাহসী ব্যক্তি। তিনি পাকিস্তানের বিষয়ে আপস করবেন না। তিনি কারও কাছে জাতির মাথা নত হতে দেবেন না। ইমরান আগেও জীবননাশের হুমকি পান বলে জানান তিনি।
ইমরান খান সাংবাদিকদের আরও বলেন, তিনি কখনো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাবেন না। কোনো অবস্থাতেই সামরিক বাহিনীকে বিতর্কিত হতে দিতে চান না জানিয়ে বলেন, ‘আমি কখনো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলব না।’ পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
ইমরান বলেন, যদি শক্তিশালী সেনাবাহিনী না থাকত তাহলে দেশ এত দিনে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যেত। তিনি বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর কারণে আমরা নিরাপদে আছি।’ অতীতে রাষ্ট্রনেতারা তাঁদের দুর্নীতির কারণে সেনাবাহিনীর ভয়ে ছিলেন দাবি করে তিনি বলেন, সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর কোনো ইস্যু নেই।
গত বছরের অক্টোবরে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আহমেদ আনজুমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা নিয়ে তখন বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। এমন কথাও উঠেছিল যে সামরিক নেতৃত্বকে পাত্তা না দিয়ে গোয়েন্দাপ্রধান নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন ইমরান খান। অক্টোবরের ওই নিয়োগ নিয়ে ইমরান খানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ইমরান বলেন, সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যে মতপার্থক্য নেই। ইমরান বলেন, ‘আমাদের সবাই তখন একমত হয়েছিলাম। কোনো মতপার্থক্য ছিল না।’
সাবেক আইএসআই প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদকে নিয়ে উপস্থাপক ইমরান খানের কাছে জানতে চান। ইমরান খানকে তিনি বলেন, জেনারেল হামিদ গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করুক, তিনি এটা চেয়েছিলেন কি না। কারণ, জেনারেল হামিদও তাঁর পছন্দের মানুষ ছিলেন। জবাবে ইমরান খান বলেন, তিন বছর জেনারেল ফয়েজ হামিদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু তিনি এটা জানতেন ২০২১ সালের শীতকাল ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় হতে যাচ্ছে।’
অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তান পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে ইমরান খান বলেন, ‘আমি তাঁকে (জেনারেল ফয়েজ হামিদ) শীতকাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার কথা বলেছিলাম। কারণ, তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের অবস্থান ছিল। কারণ, সেনাবাহিনীতে এ সবই নিয়ম। এ ছাড়া তাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এবং আমারও একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। কিন্তু তখন এ সম্পর্কে ভাবিনি যে কে নতুন সেনাপ্রধান হতে যাচ্ছেন।’
আইএসআই প্রধান নিয়োগ নিয়ে তখন সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে না জানিয়ে ইমরান খান আইএসআই প্রধান নিয়োগ দেওয়ার পর এ বিতর্ক শুরুর কথা জানিয়েছিল বিভিন্ন গণমাধ্যম। তবে গতকাল সাক্ষাৎকারে ইমরান এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দাবি, এটা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) তথ্যের অপপ্রচার।