পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় গত সোমবার। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা পর্যন্ত পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন স্পিকার আসাদ কায়সার। গতকাল আবারও পরিষদের অধিবেশন বসে। কিন্তু কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আবারও আগামী রোববার বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়।
এভাবে দিন পার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? এই প্রশ্নটাই এখন উঠছে।
ইমরান খান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন। কারণ, বিরোধীরা এককাট্টা হয়েছে। ঠিক এমন সময় তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি) জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী সোমবারের মধ্যে জাতীয় পরিষদে আস্থা ভোট হবে। পাকিস্তানের সংবিধানমতে, অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হলে এর অন্তত তিন দিন পর অথবা সাত দিনের মধ্যে ভোটাভুটি আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থাৎ সোমবারের মধ্যে এই সংকটের একটি ফয়সালা হবে।
এই পরিস্থিতি হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়েছে, এমনটা নয়। ইমরান ও তাঁর দলের কর্মকাণ্ডের কারণে জোটসঙ্গীরা তাদের ছেড়ে যাচ্ছে। আর এতে সুবিধা হচ্ছে বিরোধীদের।
পার্লামেন্টে ইমরান খানের যে খুব শক্ত অবস্থান রয়েছে, তা নয়। পার্লামেন্টে আসনসংখ্যা ৩৪২। ইমরানের জোটসঙ্গী এমকিউএম-পি জোট ছেড়ে বিরোধী শিবিরে ভেড়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে পিটিআই। আর বিরোধী শিবির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে; ১৭৭টি।
ইমরান ২০১৮ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করবেন। এই দুটি কাজের একটিও সফলভাবে করতে পারেননি তিনি।
তবে এখনো জোর গলায় নিজের সাফল্যের কথা বলে যাচ্ছেন ইমরান। গত রোববার ইসলামাবাদে বিশাল সমাবেশ করেছেন নিজের জনপ্রিয়তা প্রমাণে। এই সমাবেশ থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে আক্রমণ করেছেন তিনি। সমাবেশে একটি কাগজ দেখিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে যা হচ্ছে, তা ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’। এর সঙ্গে রয়েছে দেশীয় দোসর, যাকে ‘দুর্নীতিবাজ চোর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। এই কাগজ বা চিঠি প্রকাশের ঘোষণা বারবার দিয়েছেন তিনি। যদিও এখন পর্যন্ত সেই নথি প্রকাশ করেননি।
বলা হচ্ছে, ইমরান খানের এমন সংকটের মধ্যে পতিত হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাঁর বৈরী সম্পর্ক।
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের বর্তমান সম্পর্কে কেমন—এই বিষয়ের আগে আরেকটি বিষয় সামনে আসে। সেটি হলো, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। ইমরান সরকার জনসমর্থন হারিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি ও বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের পরিচালক উয়াজির ইউনুস বলেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী ভারতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। আর পাকিস্তানে দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
এর মধ্যে পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর সঙ্গেও ইমরানের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। এর সূচনা গত অক্টোবরে। ওই সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধানের নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিরোধের সূচনা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল ফাইজ হামিদকে নিয়ে উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তাঁকে রেখে দিয়ে একসময় সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগের পরিকল্পনা করেন ইমরান। আর তখন থেকেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর টানাপোড়নের শুরু। যদিও পরে সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার পছন্দের নাদিম আঞ্জুমকে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন ইমরান। যদিও নিয়োগপত্রে সই দেওয়া থেকে অনেক দিন বিরত ছিলেন ইমরান।
বিশ্লেষক আরিফা নুরের মতে, পাকিস্তানের বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিরোধ পুরোনো। কিন্তু পাকিস্তানের আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল ফাইজ হামিদের স্থলে কে বসবেন, তা নিয়ে ইমরানের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিরোধের সূচনা।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষক আবদুল বাসিতও এর সঙ্গে একমত। তিনি মনে করেন, ইমরান খানের একরোখা অবস্থান ও অহমের কারণে আইএসআই প্রধান নিয়োগের বিষয়টি সামনে এসেছে। যদিও এসব বিষয় বেশির ভাগ সময় আড়ালেই থাকে। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী যে সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, তা অতিক্রম করেছেন ইমরান।
এর আগে পাকিস্তানে দুবার আস্থা ভোট হয়েছিল। শওকত আজিজ ও বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে ওঠা সেই ভোটে দুজনই বেঁচে গিয়েছিলেন। এবার ইমরান কি পারবেন? আবার পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁর পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ইমরান কি পারবেন তাঁর পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে, সেই প্রশ্নই এখন জোরালোভাবে উঠছে।