প্রাণিজগৎ বুদ্ধিমান প্রাণীতে ভরপুর। তবে এ জগতে কে কতটা বুদ্ধিমান, তা নির্ণয় করা এক জটিল বিষয়। কিন্তু এটা ঠিক, প্রাণিজগতে আমরা মানুষেরাই শুধু বুদ্ধিমান নই। কেননা, আমরা এমন আচরণ দেখতে পাই, যা আগে মানুষের জন্য অনন্য বলে মনে করা হলেও দূর–সম্পর্কিত অন্যান্য প্রজাতির মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। আবার, এসব প্রজাতিকে আমরা এদের মস্তিষ্ককে এক ‘পরাশক্তির’ মতো ব্যবহার করতে দেখি।
প্রকৃতপক্ষে, প্রাণিজগতে মেধাবী মনের এত বৈচিত্র্য যে এদের তুলনা করা খুবই কঠিন। শুধু মানুষ ছাড়া কোনো প্রজাতির প্রাণীর জন্য উপযুক্ত আইকিউ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। যাহোক, বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ১০ প্রাণীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস সাময়িকী। তালিকার ক্রম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে করা নয়। আসুন, জেনে নেওয়া যাক কারা আছে সেই তালিকায়—
শিম্পাঞ্জি ও বনোবস খুবই বুদ্ধিমান। এদের রয়েছে জটিল সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস। শিম্পাঞ্জি ও মানুষের ডিএনএর মধ্যে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ মিল রয়েছে। বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের সক্ষমতার জন্য শিম্পাঞ্জির বেশ সুনাম আছে। শিম্পাঞ্জি ও বনোবস উভয়েই সমস্যা সমাধানে অসাধারণ। দ্য রয়্যাল জুলজিক্যাল সোসাইটি অব অ্যান্টোয়ার্প দেখেছে যে সমস্যার হেঁয়ালি গোছের সমাধানের ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জির চেয়ে বনোবস ভালো। তবে বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষায় বনোবসের চেয়ে এগিয়ে শিম্পাঞ্জি।
ডলফিন খুব দ্রুত শিখতে পারে। এরা মানুষের আচরণ অনুকরণে, সমস্যা সমাধানে, অন্যদের শেখাতে ও আত্মসচেতনতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। মানুষের চেয়ে ডলফিন ও তিমির মস্তিষ্ক বড়। যদিও শরীরের অনুপাতে মানব মস্তিষ্কের আকার বড়। ডলফিন ও তিমি শব্দের মাধ্যমে বস্তুর অবস্থান শনাক্ত করতে পারে। গবেষকেরা দেখেছেন যে ডলফিন নিজেদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা করে। এ ক্ষেত্রে তারা খোলস ও সমুদ্রের অন্যান্য বস্তু খেলনা হিসেবে ব্যবহার করে। প্রাণীটির রয়েছে অত্যাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থাও। এরা একে অন্যকে শনাক্ত করতে নাম উচ্চারণের মতো বিশেষ ধরনের শিস বাজিয়ে থাকে।
মানুষের কবল থেকে পালানোর অসাধারণ ক্ষমতা আছে অক্টোপাসের। এদের সম্পর্কে গল্প প্রচলিত আছে যে কীভাবে বদ্ধ ঘর বা ট্যাঙ্ক থেকে পালাতে হয় বা পানি ছিটিয়ে মাথার ওপর থাকা বাতি বন্ধ করতে হয়, তা বুঝতে পারে অক্টোপাস। তবে যেসব মানুষ অক্টোপাসের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের ভাষ্য, অক্টোপাস শুধু বুদ্ধিমানই নয়; বরং সচেতনও। দার্শনিক স্টিফান লিংকুইস্ট একসময় অক্টোপাসের আচরণ নিয়ে ল্যাবে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আপনি যখন মাছের সঙ্গে কাজ করবেন, দেখবেন, ওরা বুঝতেই পারবে না যে ওরা একটি ট্যাঙ্কের মতো কৃত্রিম কোনো পরিবেশে আছে। কিন্তু অক্টোপাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্ন। তারা বুঝতে পারে যে তারা একটি বিশেষ জায়গায় আছে আর আপনি সেটির বাইরে আছেন। বন্দিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা এদের সব আচরণ প্রভাবিত করে।’
গৃহপালিত প্রাণীরা কতটা বুদ্ধিমান হতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। কুকুর ও বিড়াল এদের চাওয়া সম্পর্কে আমাদের জানাতে পারে। কখনো কখনো এরা আমাদের ইচ্ছা বিরুদ্ধেও আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, কুকুরের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সে বিড়ালের চেয়ে দ্বিগুণ নিউরন আছে, যা এদের জ্ঞান–সম্পর্কিত বাড়তি সুবিধা দেয়। গবেষকেরা একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে বলেছেন, কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া অন্য প্রাণীদের তুলনামূলক সহজ।
অবিশ্বাস্য রকম মেধার অধিকারী হিসেবে মানুষের খানিকটা কাছাকাছি পর্যায়ের প্রাণী ওরাংওটাং। এদের অনেক প্রতিভার একটি, এরা অতীত ঘটনা সম্পর্কে অভিব্যক্তি প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে। ওরাংওটাং ছাড়া এ আচরণ শুধু মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।
গবেষকেরা জানান, ২০১৮ সালে শিশুসহ কিছু প্রাপ্তবয়স্ক সুমাত্রীয় ওরাংওটাং একটি সম্ভাব্য শিকারীকে দেখার পরে সতর্কবার্তা দিতে ২০ মিনিট পর্যন্ত দেরি করেছিল। এরা শিকারীকে নিজেদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানান দিতে চায়নি। পরে প্রাপ্তবয়স্ক ওরাংওটাংগুলো বাচ্চাদের বিষয়টি শেখানোর জন্য এমন শব্দ করেছিল যে যার অর্থ—এ ধরনের শিকারের মুখোমুখি হওয়া বিপজ্জনক। অতীত কিংবা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কোনো ঘটনা সম্পর্কে তথ্য আদান–প্রদানের এ পদ্ধতিকে মানুষের ভাষার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়।
মস্তিষ্কের আকার নয়; বরং কেউ কীভাবে এটি ব্যবহার করছে, সেটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কথাটির জীবন্ত প্রমাণ কাক। প্রাণীটি খুব দ্রুত শেখে। গবেষণায় দেখা গেছে, চার মাস বয়সী একটি কাক প্রাপ্তবয়স্ক কিছু শিম্পাঞ্জির সমান বুদ্ধিমান হতে পারে।
পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে, কাক ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতে পারে। কাকেদের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি আছে। এরা মানুষের চেহারা মনে রাখতে পারে। নির্দিষ্ট মানুষকে বন্ধু কিংবা শত্রু হিসেবেও শনাক্ত করতে পারে।
অনেক পাখিই মানুষের কথা নকল করতে পারে। কিন্তু আফ্রিকার ধূসর তোতাপাখিকে সবচেয়ে দক্ষ বক্তা বলা হয়ে থাকে। পরীক্ষা–নিরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, এরা শব্দের অর্থ বোঝে ও পাঁচ বছরের মানবশিশুর চেয়েও বেশি বোধসম্পন্ন কিছু কাজ করতে পারে।
মৌমাছিকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান পতঙ্গ। এর বেশ কারণও আছে। এরা হেঁয়ালির সমাধান করতে পারে। এদের ব্যতিক্রমী চলাচলের দক্ষতা আছে। একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, মৌমাছিরা ফুলের কাছে যাওয়ার সর্বোত্তম পথ তৈরি করে বারবার পরিদর্শন করে। এটি সেখানে পৌঁছাতে এদের গড়পড়তা সময়কে হ্রাস করে উল্লেখযোগ্যভাবে। আরেক পরীক্ষায় দেখা গেছে, মৌমাছি মানুষের মতো বস্তুর মানসিক চিত্র তৈরি করে এবং এদের ইন্দ্রিয়জুড়ে বস্তুর স্বীকৃতি পাঠাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মৌমাছি স্পর্শের মাধ্যমে অন্ধকারে বস্তু শনাক্ত করতে পারে, যদি এরা সেগুলো আগে দেখে থাকে।
বুদ্ধিমান প্রাণীর এ তালিকায় বানর প্রজাতির সব প্রাণী আছে। কিছু সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে শিম্পাঞ্জি, বনোবস ও ওরাংওটাংয়ের পাশাপাশি গরিলাদেরও যোগাযোগের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। কোকো নামে এক বিখ্যাত গরিলা সাংকেতিক ভাষা আয়ত্ত করেছে বলে জানা গেছে। বনাঞ্চলে গরিলারা নানা রকম উপকরণ ব্যবহার করে, ব্যস্ত সামাজিক জীবনযাপন করে, এমনকি হাসেও।
মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা মানুষেরাও একধরনের প্রাণী। তবে আমরা সেরা বুদ্ধিমান প্রাণী। অবশ্য, আমরা এখনো অন্যান্য প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। যদিও এটা সত্য, প্রাণিজগতে বুদ্ধিমান অনেক প্রজাতি রয়েছে এবং আমাদের এখনো এদের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু শেখার বাকি; তবু এটা স্পষ্ট, আমাদের বুদ্ধিমত্তা বাকিদের থেকে তুলনার বাইরে বেশি। মানুষ ছাড়া এ তালিকার আর কিছুই জটিল সভ্যতা তৈরি করেনি, চাঁদেও যায়নি। কিন্তু আমরা তা করেছি।