বুশ ও ব্লেয়ার থেকে কিছুই শেখেননি পুতিন

পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া গত কয়েক দশকে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধে জড়িয়েছে। ক্ষমতাধরদের নিশানার তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন ইউক্রেন। যেখানে এখনো বিশেষ সামরিক অভিযানে রয়েছেন রাশিয়ার সেনারা। কয়েক বছর লড়াই চালিয়েও আফগানিস্তান ও ইরাকে জয়ী হতে পারেনি রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এখন ইউক্রেনেও পাল্টা–আক্রমণের মুখে পিছু হটতে হচ্ছে রুশ বাহিনীকে। এ প্রেক্ষাপটে পরাশক্তিগুলোর যুদ্ধ উন্মাদনা ও পরিণতি নিয়ে আল–জাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন কলামিস্ট অ্যান্ড্রু মিট্রোভিক। নিবন্ধটির সংক্ষেপিত অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।

রাশিয়ার সোচি শহরে ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

আমরা পরাশক্তিগুলোর মৃত্যু দেখছি। মার্ভেলের কমিকসে যে পরাশক্তি দেখানো হয়, এটা তা নয়। হলিউডের বক্স অফিসে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা মার্ভেলের চলচ্চিত্রগুলো (স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান, অ্যাভেঞ্জারস প্রভৃতি) নিয়ে মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসেসির সাফ বক্তব্য ছিল, এগুলো কোনো ‘সিনেমাই নয়’। তবে হ্যাঁ, আমিও মনে করি, এই চলচ্চিত্রগুলো শিল্প–বর্জিত জঞ্জাল।

পরাশক্তি বলতে আমি বুঝিয়েছি সেই সব দেশকে, যারা প্রয়োজন ছাড়াই পারমাণবিক অস্ত্রের পাহাড় গড়ে তুলেছে। তাদের ভান্ডারে রয়েছে প্রচলিত সব সমরাস্ত্রের বিপুল মজুত। এর মধ্য দিয়ে ওই দেশগুলো পরাশক্তি তকমা বাগিয়ে নিয়েছে। এই তকমা দেওয়াটা শুরু হয়েছে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।

এখন এই পরাশক্তিগুলোর একটি ছোট তালিকা তুলে ধরা যাক। যৌক্তিকভাবেই এই তালিকায় ক্রমানুসারে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য। ২০২০ সালে সামরিক খাতে এই ৪ দেশের মোট খরচ ১ দশমিক ১৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই খরচ করেছে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার।

আমরা চীনকে আপাতত আলোচনার বাইরে রাখি। এবার একটি প্রশ্ন তোলা যাক। সেটি হলো, একাবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে পরাশক্তি—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সামরিক দিক দিয়ে কী মিল আছে?

উত্তরটা হলো, রাস্তায় নেমে লাখ লাখ মানুষের বিক্ষোভ, নিজ দেশের অনেক সাধারণ নাগরিকের বিরোধিতা, জাতিসংঘ—এমনকি কখনো কখনো নিজ দেশের কূটনীতিকদের সমালোচনা সত্ত্বেও এই তিন দেশ মূর্খের মতো বিভিন্ন অজুহাতে ইরাক, আফগানিস্তান ও ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে।  

দেশগুলোকে বারবার সতর্ক করা হয়েছিল যে তাদের তথাকথিত ‘স্বাধীনতা’ প্রতিষ্ঠার বয়ানের মধ্য দিয়ে নিজেদের খোঁড়া গর্তে তারা নিজেরাই পড়বে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার অতি আত্মবিশ্বাসী নেতারা নিজ দেশের যুদ্ধপন্থীদের সমর্থন ও উৎসাহ পেয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।  

যাহোক, পরাশক্তিগুলো এবং তাদের পাশে থেকে হাততালি দেওয়া সমর্থকেরা ব্যর্থ হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে বিদ্রোহের মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য শুধু পরাজয় স্বীকার করেনি, একই সঙ্গে তাদের পরাশক্তি খেতাবও মলিন হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে তাদের অপমানিত ও মাথা নত করে নিজ ডেরায় ফিরে যেতে হয়েছে।  

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের ভুল থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এটা বোঝা উচিত ছিল, পরাশক্তি হিসেবে আপনি যা ভেবে ছোট একটি দেশে হামলা চালান এবং হামলার পর আদতে যা ঘটতে পারে, তার মধ্যে ফারাক আছে। পরাশক্তি হওয়াটা আসলে জয়ের নিশ্চয়তা দেয় না।

পরাশক্তিগুলোর আগ্রাসন যেসব সময় সফল হয় না তা বুঝতে বুশ ও ব্লেয়ারের ব্যর্থতার দিকে তাকানোর দরকার ছিল না পুতিনের। তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভের কথা স্মরণ করলেই পারতেন। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসন কায়েম করতে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে দেশটিতে হামলা চালিয়েছিলেন তিনি। তবে স্থানীয়দের গেরিলা বাধার মুখে তাঁর সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।  

এই ব্যর্থতার কারণে পরাশক্তি রাশিয়ার যে অবমাননা হয়েছিল, তা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন অথবা মানতে চাননি পুতিন। আরও বড় বিষয় হলো, পুতিন তাঁর পূর্বসূরি ব্রেজনেভের ধ্বংসাত্মক ওই কর্মকাণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করেননি। তিনি বরং নিরাপরাধ বহু মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইউক্রেনে একটি অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে জড়িয়েছেন।

সম্প্রতি খেরসন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের পর শহরটির রাস্তায় রাস্তায় ইউক্রেনের অধিবাসীরা নিজ দেশের সেনাদের বরণ করছেন—এমন ছবি প্রকাশ পেয়েছে। প্রবল প্রতাপশালী পরাশক্তিগুলোকেও যে কুপোকাত করা যায়, ছবিগুলো তারই প্রমাণ। এর পরও পুতিন ক্ষমতার ভ্রমে রয়েছেন।

একটি পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়া যে কতটা হঠকারী ও ব্যর্থ হতে পারে, তা বোঝা গেছে ইউক্রেনে ‘সীমিত’ আকারে পারমাণবিক হামলা বিষয়ে আলোচনা থেকে।

এর মধ্য দিয়ে আমার মনে হয়েছে, রাশিয়ার লক্ষ্য, কিয়েভ, লন্ডন, বার্লিন, প্যারিস ও ওয়াশিংটনকে শুধু এটা বোঝানোই নয় যে এই অঞ্চলে তারা আর অবিসংবাদিত ‘নেতা’ নেই; বরং এটাও বোঝানো যে নিজেদের মার খাওয়া সেনাবাহিনীকে রক্ষায় তারা পারমাণবিক বা হাইড্রোজেন বোমাও ব্যবহার করতে প্রস্তুত আছে।

যদি রাশিয়া পারমাণবিক হামলা চালায়, তার জবাবও পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে আসতে পারে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো একই মানসিকতার শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পতন শুরু হতে পারে। ফল যেটা দাঁড়াবে, তা হলো, আমরা সবাই নরকের মধ্যে পড়ব।
এরই মধ্যে গত আগস্টে তাইওয়ানে সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। এ নিয়ে মহাখাপ্পা হয় চীন। একপ্রকার হুঁশিয়ারি দিয়ে তারা বলেছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে।’

একটি পরাশক্তি হিসেবে চীন তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। তবে তারা তাইওয়ান আক্রমণ করলে সেটি ইরাক, আফগানিস্তান ও ইউক্রেন যুদ্ধের মতো নিরর্থক হতে পারে এবং অগনিত মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

তবে কথা হলে চীন হয়তো তাইওয়ানে হামলার বিষয়ে উচ্চবাচ্যই করে যাবে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মতো কামড় দেবে না।