নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি রেস্তোরাঁয় ইফতারির পসরা
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি রেস্তোরাঁয় ইফতারির পসরা

জ্যাকসন হাইটসে একদিন ইফতার

এক পাউন্ড জিলাপি ৯ ডলার। এক বাক্স ইফতারি—তাতে বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, খেজুরের সঙ্গে খানিকটা তেহারিও আছে দাম ১০ ডলার। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি পাড়া জ্যাকসন হাইটসের রেস্তোরাঁগুলো বিকেল থেকেই পসরা সাজিয়ে বসেছে। আর সারি সারি ট্রে-ভরা মুরগি, খাসি, গরুর মাংসের নানা ধরনের কাবাব, চপ, পরোটা আর বিভিন্ন মিষ্টান্ন তো আছেই। আছে খেজুরের গুড়ের জিলাপি কিংবা দুধসেমাই।

কিন্তু জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় বিকেল পাঁচটার সেই ভিড়টা কই, যা গত বছর রোজার দিনগুলোতেও ছিল? ১৮ মার্চ ২০২৫ বিকেলে ডাইভারসিটি প্লাজা এত ফাঁকা লাগছে কেন? ইফতারের সময় ৭টা ৬ মিনিট। রেস্তোরাঁর দোকানি, কর্মচারী—যাঁরা বেশির ভাগই বাঙালি, বাংলায় কথা বলেন; জানালেন, হঠাৎ করেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন, তারপর অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ; আর তাতেই বাংলাদেশি, নেপালি, ভারতীয়, পাকিস্তানিতে গমগম করা এসব এলাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা। ঈদের আগে পসরা সাজিয়ে রেখেছেন যে শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবি-পায়জামার দোকানিরা, তাঁরাও অনেকটাই বেজার মুখে তাকিয়ে থাকেন প্রায় জনশূন্য ফুটপাতের দিকে।

এক বাক্স ইফতারি—তাতে বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি, খেজুরের সঙ্গে খানিকটা তেহারিও আছে দাম ১০ ডলার
ছবি: লেখক

তারপরও বিক্রি হয় ঠিকই। নবান্ন, ইত্যাদি, শানাই, ঘরোয়া, সাগর ইত্যাদি নামের রেস্তোরাঁগুলোর চেয়ারগুলো ভরে যায় সন্ধ্যা নামার আগে আগে। নবান্ন রেস্তোরাঁর পাশের লেনের ভেতরে মসজিদ। নিউইয়র্কের মসজিদগুলোতে ইফতারির ব্যবস্থা থাকে। সেখানেও ভিড় গত বছরের তুলনায় কমে গেছে, জানালেন নিউইয়র্কপ্রবাসী বন্ধুসভার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্স শাহ আলম।

ফাঁকা ফাঁকা জ্যাকসন হাইটসের রাস্তায় হঠাৎ করেই প্রিন্সের দেখা পেয়ে ভালোই লাগল। এখানকার প্রায় সব রেস্তোরাঁর মালিক কিংবা ম্যানেজারের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক। কথা বলি শানাইয়ের স্বত্বাধিকারী রঞ্জিত দেবের সঙ্গে। কথা হয় মেরিট কাবাবের ব্যবস্থাপক ফিরোজ আহমেদের সঙ্গে। সবারই অভিমত, রাস্তায় মানুষ কমে গেছে। নিউইয়র্কের ঐতিহ্যবাহী বাংলা পত্রিকা ঠিকানার চেয়ারম্যান এম এম শাহিন ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দেন তাঁর অফিসকক্ষে বসে। রাস্তাতেই তাঁর সঙ্গে দেখা। খাতির করে দোতলার অফিস রুমে নিয়ে গেলেন তিনি। সেখানে প্রবীণ সাংবাদিক, পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমানের সঙ্গে বহু বছর পর দেখা হয়ে গেল। এম এম শাহিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ডাইভারসিটি প্লাজার সেই ভিড়ভাট্টা, হইচই কোথায় গেল? পুরান ঢাকার চকবাজারের ভিড়ভাট্টার কথা স্মরণ করিয়ে দিত যে ভিড় একসময়! শাহিন ভাই বললেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর থেকেই রাস্তাঘাটে মানুষ কমে গেছে। কী দরকার ঝামেলায় জড়ানোর। অভিবাসী পুলিশ একে ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, জোর করে বিমানে উঠিয়ে দিচ্ছে—সংবাদমাধ্যম এ ধরনের খবরে ভরপুর।

হাটবাজারের হালিম নাকি পুরো নিউইয়র্কে সবচেয়ে বিখ্যাত—১০ ডলার থেকে ২০ ডলারের একটা করে বাটি

হাটবাজারের হালিম নাকি পুরো নিউইয়র্কে সবচেয়ে বিখ্যাত—১০ ডলার থেকে ২০ ডলারের একটা করে বাটি। এই দোকানের কর্মীরা এই নিয়ে গর্বিত। রাস্তায় ভ্যানে ঝালমুড়ি, ফুচকা ইত্যাদি সাজিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ‘পুরান ঢাকা’ সাইনবোর্ড লাগিয়ে। বিক্রেতা জানালেন, বিক্রি কমে গেছে। ভিড়ই নেই, বিক্রি বাড়বে কোত্থেকে। তবে ইফতারের পরে ফুচকা বা ঝালমুড়ির টানে অনেকেই আসেন।

ইফতারের আগে আগে আমরা গিয়ে বসি একটা রেস্তোরাঁয়। নিচতলায় হল রুম আছে। সেখানেও ইফতারের মাহফিল। ওপরে গোটা ত্রিশেক আসন, ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে গেল। সবাই ইফতারি সামনে নিয়ে বসে আছেন। ৭টা ৬। ইফতারি খাওয়া শুরু করলেন সবাই। আজানের ধ্বনি যদিও শুনতে পেলাম না।

রেস্তোরাঁর কর্মী দুজন অল্প বয়সী তরুণী সাড়ে সাতটার সময়ও বড় ব্যস্ত। খদ্দেরদের খাবার, পানি নানা কিছু এগিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। জিজ্ঞাসা করলে জানা গেল, তাঁরা রোজা আছেন; কিন্তু মুখে পানি দেওয়ার সময় পাননি।

এই তরুণীরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, নিউইয়র্কের কলেজে পড়েন। পড়ার খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ জোগাড় করার জন্য বাংলাদেশি মালিকের রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। ইফতারের সময় পেরিয়ে যায়, মুখে পানি দেওয়ার সময় পান না। ইফতারের শেষে সব খদ্দের চলে যান, রেস্তোরাঁ ফাঁকা হয়ে যায়। তখনো এই তরুণীরা ব্যস্ত টেবিল পরিষ্কার করা থেকে খাবারের সারি সারি ট্রেগুলো সামলাতে। বেঁচে যাওয়া খাবার গোছগাছ করতে। এই মেয়েরা ইফতারি মুখে দেবেন কখন?

ডোনাল্ড ট্রাম্প এই তরুণীদের বেদনা বুঝবেন না। এটাও উপলব্ধি করতে পারবেন না যে এই অভিবাসী কর্মীরাই আমেরিকার অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছেন।

ইফতারি না খান, তরুণী দুজন একটু পানি তো মুখে দিতে পারেন! এই কথাটা বলতে ইচ্ছা করে, কী জানি বলাটা সংগত হবে কি না, বুঝতে পারি না।