১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানে হামলা শুরু করেছিল ইরাক। দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। ভূখণ্ডগত, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিরোধকে কেন্দ্র করে তেলসমৃদ্ধ দুই দেশের মধ্যে শুরু হওয়া ওই যুদ্ধ আট বছর চলেছিল। ওই যুদ্ধে পাঁচ লাখেরও বেশি সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। ৪৪ বছর আগে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে আজকের এ ফিরে দেখা।
২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০। ইরাকের সেনারা সীমানা পেরিয়ে ইরানে ঢুকে পড়ে। একই সঙ্গে ইরানের বিমানঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে চলতে থাকে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। ইরানি বাহিনীও পাল্টা হামলা চালাতে থাকে। শুরু হয় ইরাক-ইরান যুদ্ধ। মূলত সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করেই তখন যুদ্ধে জড়িয়েছিল দুই দেশ। এটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত।
ইরান ও ইরাকের মধ্যে প্রায় ১ হাজার মাইল দীর্ঘ সীমান্ত আছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো বিশেষ করে ইরানের খুজেস্তান এবং ইরাকের বসরা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ভূখণ্ডগত বিরোধের জায়গাটি পুরোনো। তবে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরুর আগে শাত আল–আরব নদীর সীমানা নির্ধারণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছিল। তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে শাত আল-আরব জলপথকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হতো। এ নিয়ে ইরান ও ইরাকের বিরোধ মেটাতে ১৯৭৫ সালে আলজেরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে তখন আলজিয়ার্স অ্যাগ্রিমেন্ট নামক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। চুক্তির আওতায় শাত আল-আরব নদীর সীমা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় ইরাক ও ইরান। পাশাপাশি ইরান কুর্দি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়া বন্ধ করার ব্যাপারে সম্মত হয়। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে উত্তেজনা কিছুটা কমেছিল ঠিকই, তবে এর মধ্য দিয়ে ভূখণ্ডগত ও মতাদর্শিক বিরোধগুলো মেটানো যায়নি।
১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তৎকালীন শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ইরানে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির অধীনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশটি পশ্চিমাপন্থী অবস্থান থেকে সরে পশ্চিমাবিরোধী দেশে পরিণত হয়।
এদিকে ১৯৭৯ সালে সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হন। আর ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে আবদুল হাসান বনি-সদর ইরানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। ওই বছরের ৮ মার্চ থেকে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। ইরান তখন ইরাক থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়। এপ্রিলে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজ এবং সংস্কৃতি ও তথ্যমন্ত্রী লতিফ নুসেইফ আল জসিমকে হত্যার ঘটনায় উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। একই বছরের মে ও আগস্ট মাসে ইরাক-ইরান সীমান্তে সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে যায়।
১৯৮০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্স চুক্তি বাতিল করে ইরাক শাত আল-আরব জলপথের ওপর পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করলে পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর শেষ পর্যন্ত ২২ সেপ্টেম্বর ইরানে হামলা শুরু করে ইরাকি বাহিনী।
কলাম্বিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অনলাইনের (সিআইএও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানে হামলার পেছনে ইরাকি বাহিনীর অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল দেশটির আবাদান ও খুজিস্তান অঞ্চলের তেল শোধনাগারের দখল নেওয়া। তবে যুদ্ধের প্রথম দিন দুই পক্ষের কেউই কারও তেলক্ষেত্রে হামলা চালায়নি। ধারণা করা হয়, প্রতিশোধ হামলার আশঙ্কায় দুই পক্ষের কেউই আবাদান কিংবা বসরায় একে অপরের তেলক্ষেত্রে আঘাত করেনি। প্রথম দিন আবাদান তেল শোধনাগারের আশপাশে লড়াই চললেও শোধনাগারটি অক্ষত ছিল। তবে পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বর আবাদানে হামলা শুরু করে ইরাক। একের পর এক হামলায় সেখানকার তেল ও গ্যাসের ট্যাংকগুলো যেন আগুনের কুণ্ডলীতে পরিণত হয়। ইরান তখন ঘোষণা দেয় হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে কোনো জাহাজকে শত্রুপক্ষের বন্দরগুলোর দিকে যেতে দেওয়া হবে না। ইরাকি বাহিনীর হামলায় আবাদানে তেল শোধনাগারটি বন্ধ হয়ে যায়।
যুদ্ধের শুরুতেই সৌদি আরব ও কুয়েত ইরাককে সমর্থন দেয়। সুন্নি–অধ্যুষিত আরব দেশগুলো ইরাককে প্রচুর আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। তারা ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ইরানের শিয়াপন্থী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে বিবেচনা করছিল। পশ্চিমা দেশগুলো ইরাকের কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছিল।
যুদ্ধের শুরুর দিকে ইরাকি বাহিনীকে খুব বেশি একটা প্রতিরোধ করতে পারেনি ইরানি বাহিনী। ইরাক শুরুতে কাসর ই শিরিন এবং মেহরান শহরের দখল নেয়। ইরানের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় খোররামশাহর বন্দরেরও দখল নেয়। ১৯৮২ সালে ইরাকের কাছ থেকে নিজেদের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল কুজেস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে পাল্টা হামলা চালায় ইরান। খোররামশাহর বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় তারা। বাগদাদ তখন যুদ্ধবিরতি এবং সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়। তবে ইরান যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
এরপর ইরান ইরাকের বসরা বন্দরনগরীতে হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৮২ সালের জুলাইয়ে তারা দক্ষিণাঞ্চলে বড় অভিযান শুরু করে। ওই বছরের আগস্টে ইরান উপকূলবর্তী খারগ দ্বীপ এলাকার প্রধান তেল টার্মিনাল দখল করে। ১৯৮৪ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের মধ্যে শহর দখলের লড়াই শুরু হয়। ওই সময় দুই দেশের ৩০টি শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে।
১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের সমাধান প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ওই প্রস্তাবটি এক বছর আগেই জাতিসংঘ অনুমোদন দিয়েছিল এবং ইরাক তা গ্রহণও করেছিল। এক বছর পর্যন্ত তা ইরানের সম্মতির অপেক্ষায় ছিল। ১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়।
তবে দুই দেশের মধ্যে আলজিয়ার্স চুক্তি আবারও কার্যকর হতে দুই বছর লেগেছিল। ১৯৯০ সালের আগস্টে তা কার্যকর হয়েছে। চুক্তির আওতায় ইরাক ইরান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
সূত্র: এএফপি, কলাম্বিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অনলাইন, মিডলইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স