ইসরায়েলের ‘হাসবারা’ কতটা বিশ্বাস করছে বিশ্ববাসী

গাজায় একমাস ধরে নির্বিচার বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিয়েছে গাজা। উপরন্তু চলমান এই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণকে বদলে দিতে পারে। আগামী কয়েক বছর ফিলিস্তিনকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকট হিসেবে আবারও কেন্দ্রীভূত করতে পারে।

ব্রিটেনের সহায়তায় ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটির সুরক্ষায় কাজ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ; তাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে এককভাবে ইসরায়েলিরা।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারত্ব ও বর্ণবাদী আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা’, ‘ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা’, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার’-এর মতো আরও অনেক রাজনৈতিক ভাষ্য পশ্চিমে উচ্চারিত হয়ে আসছে।

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুর মৃতদেহ জড়িয়ে স্বজনের কান্না

নিপীড়িতের ওপর নিপীড়কের ‘অধিকার’ রয়েছে—সংঘাত নিয়ে মার্কিন-পশ্চিমাদের এই উদ্ভট অবস্থানই ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সামরিক দখল বজায় রাখার সক্ষমতা জুগিয়ে আসছে; যে দখলদারত্ব চলছে ৫৬ বছরের বেশি সময় ধরে।

আর এ পরিস্থিতিই ইসরায়েলকে ‘সংঘাতের’ মূলগত বিষয়টিকে উপেক্ষা করার জন্যও যথেষ্ট বলীয়ান করে তুলেছে। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে জাতিগত নির্মূল ও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের অধিকার দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করে আসা তারই এক উদাহরণ।

শান্তির জন্য ফিলিস্তিনি-আরবদের প্রতিটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এমনকি ‘শান্তিপ্রক্রিয়া’, অর্থাৎ অসলো চুক্তিও তেল আবিবের জন্য তার সামরিক দখলদারত্ব, বসতি সম্প্রসারণের পাশাপাশি বান্তুস্তানের মতো স্থানে ফিলিস্তিনিদের ঠেলে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বান্তুস্তান ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের আমলের সেই এলাকা, যেটা নির্ধারিত ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য—অপমান ও বর্ণগতভাবে বিচ্ছিন্ন করার।

কিছু ফিলিস্তিনি মার্কিন-ইসরায়েল শান্তির লভ্যাংশ পাওয়ার জন্য সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমেরিকার প্রচার-প্রচারের ফাঁদে পা দিয়েই হোক বা পরাজয়ের দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতিতে ভেঙে পড়া থেকেই হোক, তাঁরা মিথ্যা প্রতিপত্তি, নামমাত্র উপাধি ও সীমিত ক্ষমতার করুণ টুকরা পেতে চাইছেন। মজার বিষয় হলো, এসব ইসরায়েল নিজেই দেয়, আবার নিজেই তা প্রত্যাহার করে নেয়।

ইসরায়েলি বোমায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাড়িঘর। উদ্বেগ আর আতঙ্ককে সঙ্গী করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুরা। ১১ অক্টোবর, গাজা সিটি

যাহোক, গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলি যুদ্ধ এরই মধ্যে এই বেদনাদায়ক অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে যা জোর গলায় বলে আসছে, তা হলো তাদের প্রাণঘাতী যুদ্ধ হামাসের বিরুদ্ধে, ‘সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে, ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে। যাঁরা ইসরায়েলের চোখ দিয়ে ঘটনাগুলো দেখতে রাজি, তাঁরা হয়তো তাদের এ কথায় আস্থা রাখতেও পারে।

কিন্তু হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকের মরদেহ, যাদের মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার শিশু—এসব মরদেহ গাজার হাসপাতালের মর্গে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে এবং আরও মর্মন্তুদ হলো মরদেহগুলো রাস্তাঘাটেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এই পটভূমিতে ইসরায়েলের বয়ান বদলে যেতে শুরু করেছে।

পুরো পরিবারের সঙ্গে নিহত ফিলিস্তিনি শিশুদের মরদেহ ইসরায়েলের বর্বরতার, দেশটির মিত্রদের অনৈতিক সমর্থনের সাক্ষী হয়ে ওঠে। খুনিকে পুরস্কৃত করে এবং ভুক্তভোগীকে তিরস্কার করে—আন্তর্জাতিক এমন অমানবিক অবস্থারও সাক্ষ্য হয়ে ওঠে এসব মরদেহ।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সব বক্তব্য-বিবৃতিই পক্ষপাতমূলক। এগুলোর একটিতে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা নিহতের সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা বলছে। এটি সম্ভবত মার্কিন প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে অমানবিক বিবৃতি।

ওয়াশিংটন হয়তো এখনো বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি, তবে ইসরায়েলের প্রতি তাদের নিঃশর্ত সমর্থনের পরিণতি ভবিষ্যতে বিপর্যয়কর প্রমাণিত হতে পারে। কেননা, যে অঞ্চলটি যুদ্ধ, আধিপত্য, ‘এক চোখে নুন বেচা, অন্য চোখে তেল বেচা’ নীতি, সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও লাগাতার সংঘাতে বিরক্ত, সেই অঞ্চলের ক্ষেত্রে এ কথা বেশি করে প্রযোজ্য। এর জেরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ইসরায়েলেই।

গত ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর অত্যন্ত আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দেন, কথা বলতে বলতে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা অবিরাম হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেন, যা ফিলিস্তিনের প্রতি ক্রমবর্ধমান সমর্থনেরই প্রতিফলন। শুধু জাতিসংঘেই নয়, বিশ্বব্যাপী শত শত শহরে ও অগণিত রাস্তায় তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

এর বিপরীতে জাতিসংঘে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, একজনও হাততালি দেননি। তেল আবিবের বেশির ভাগ মিথ্যা প্রচারণার (হাসবারা) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এরগান, বিশেষ করে যুদ্ধের প্রথম দিকে।

ইসরায়েলি আখ্যান স্পষ্টতই ভেঙে পড়েছিল, হাজার টুকরা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েল কখনোই এতটা বিচ্ছিন্ন বোধ করেনি। এটি অবশ্যই ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ নয়, যা নেতানিয়াহু ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

কীভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে দেখানো প্রাথমিক সহানুভূতিকে তারা দ্রুত ঘৃণায় পরিণত করে, তা বুঝতে অনেকেই অক্ষম। অথচ ইসরায়েল সেই পুরোনো কৌশল অবলম্বন করেছিল।

জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে গত মঙ্গলবার প্রথম হামলাটি চালায় ইসরায়েল, গাজার জাবালিয়া, ৩১ অক্টোবর

২৫ অক্টোবর এরদান জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে ‘জাতিসংঘের নেতৃত্বের অযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেন; তাঁর পদত্যাগের দাবি করেন। ‘হামাসের আক্রমণ শূন্য থেকে হয়নি’ বলাই সম্ভবত এরদানের চোখে গুতেরেসের তথাকথিত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

গাজায় ইসরায়েলের চালানো গণহত্যার পক্ষে যে নিখুঁত চিত্র দাঁড় করানো হয়েছে, তার সামান্যতম এদিক-সেদিক করার মতো কোনো কিছুই অনুমোদিত নয়। ইসরায়েল ও তার মার্কিন হিতৈষীরা তো এ ব্যাপারে ভয়াবহ উদ্বিগ্ন। আর এটাই হলো ‘নিখুঁত ইসরায়েলি বিশ্ব’, যেখানে কাউকে সামরিক দখল, অবরোধ, রাজনৈতিক সম্ভাবনার ঘাটতি, ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায়সংগত শান্তির অনুপস্থিতির কথা বলার অনুমোদন দেওয়া হয় না।

যদিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিবৃতিতে রাখঢাক না রেখেই বলেছে, উভয় পক্ষই ‘যুদ্ধাপরাধসহ আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন’ করেছে। এর বিপরীতে ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছে; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাটিকে ‘ইহুদিবিরোধী’ বলে অভিযুক্ত করেছে তারা।

কারণ, ইসরায়েলের চিন্তাধারায় বিপরীতে যায়, এমন কোনো কিছুই যে অনুমোদিত নয়, তারই প্রমাণ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতি তাদের আচরণ। গাজার নৃশংসতা সম্পর্কে বলা কিংবা সংঘাতের অন্যতম ‘মূল কারণ সব ফিলিস্তিনির ওপর ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া বর্ণবাদের ব্যবস্থা’কে চিহ্নিত করা তাই মেনে নেওয়া হয় না।

ইসরায়েল আর যে সর্বশক্তিমান নয়, এটি এখন আমাদের ভাবনায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রমাণ করেছে, ইসরায়েলের ‘অজেয় সেনাবাহিনী’ আসলে কাগুজে বাঘ। যদিও ইসরায়েল ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল বিশ্বের দশম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানিকারক দেশ—এই ভাষ্যই ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ‘অজেয়’, তেমন ব্র্যান্ড তৈরি করেছিল।

এই কাগুজে বাঘে পরিণত হওয়ার বিষয়টিই ইসরায়েলকে সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। ইসরায়েলের জাতীয় দৈনিক আরুৎজ শেভাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেসেটের সাবেক সদস্য মোশে ফিগলিন বলেছেন, ‘মুসলিমরা আর আমাদের ভয় পায় না।’ এই ভয় পুনরুদ্ধার করতে ইসরায়েলি চরমপন্থী এই রাজনীতিবিদ ‘অবিলম্বে গাজাকে পুড়িয়ে ছাই’ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে কিছুই গাজাকে ছাইয়ে পরিণত করতে পারবে না। যদিও যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে উপত্যকাটির ওপর ১২ হাজার টনের বেশি বিস্ফোরক ফেলা হয়েছে। অন্তত ৪৫ শতাংশ বাড়িঘর ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই হিসাব জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের।

গাজা মরবে না। কারণ, এটি এমন এক শক্তপোক্ত ধারণা, যা প্রত্যেক আরবের, প্রত্যেক মুসলমানের ও বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ও মনের গভীরে প্রোথিত।

এই নতুন ধারণা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করছে, যার মূল কথা হলো বিশ্বের অগ্রাধিকারে থাকবে ইসরায়েল; দেশটির নিরাপত্তা, শান্তির স্বার্থপর সংজ্ঞাসহ অন্যান্য সব বিভ্রম পূরণ করতে হবে।

নিপীড়কের নয়, অগ্রাধিকার পাবে নিপীড়িত—আলোচনা এখন এ অবস্থানে ফিরে আসা উচিত, যেমনটা আসলে সব সময়ই উচিত ছিল।

এখনই সময় ফিলিস্তিনের অধিকার, নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলার। বাস্তবিক অর্থে এটা আসলে কর্তব্য, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য আমাদের এসব নিয়ে কথা বলতে হবে।

ন্যায়বিচার নিয়েও কথা বলার সময় এখন—প্রকৃত ন্যায়বিচার, যার ফলাফল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সমতা, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার, স্বাধীনতা ও প্রত্যাবর্তনের অধিকার প্রশ্নে ন্যায়বিচার।

গাজা আমাদের এসবসহ আরও অনেক কিছু বলছে। আমাদেরও শোনার সময় এসেছে।

  • রামজি বারোদ: সম্পাদক, প্যালেস্টাইন ক্রনিকল

  • ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: হাসান ইমাম