‘আমি একজন কারাবন্দী’: যেমন আছেন ঘরবন্দী মধ্যপ্রাচ্যের নারীরা

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের নারীদেরই অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে হয়  
ছবি: রয়টার্স

নাম তাঁর আয়া। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। জর্ডানের রাজধানী আম্মানের বাসিন্দা আয়া ঘরের বাইরে যেতে পারেন না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। কোথায় থাকবেন, কী কাজ করবেন অথবা পড়াশোনা কোথায় করবেন— এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাঁর নেই।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে শুধু আয়া নন, বেশির ভাগ নারীর গল্পটাই এমন। জর্ডান, ইরান ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোতে এখনো নারীদের জন্য নিপীড়নমূলক আইন রয়েছে। এসব আইন অনুযায়ী নারীরা স্বামীর আদেশ মানতে বাধ্য থাকবেন। এ ছাড়া কোথাও চাকরি করতে চাইলে, ঘুরতে যেতে চাইলে বা শ্বশুরবাড়ি থেকে যেতেও স্বামীর অনুমতি নিতে হবে।

নিজের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আয়া বলেন, ‘আমি যেন বাড়িতেই একজন কারাবন্দী। পরিবারকে না জানিয়ে আমি যদি বাইরে যাই, তাহলে তাঁরা আমাকে একটি ঘরে আটকে রাখবে এবং আমাকে এমনভাবে মারধর করা হবে যে কয়েক মাস ধরে আমাকে সে ব্যথা বয়ে বেড়াতে হবে। আমাকে তো হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। শুধু আমি নই, অনেক মেয়ের অবস্থাই আমার মতো।’

যদিও এই অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশের সরকার বলে থাকে তারা নারীদের পাসপোর্ট পেতে এবং অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দিচ্ছে। কিন্ত এসব দেশেই বিবাহিত নারীদের নিয়ে যেসব আইন রয়েছে, তাতে এসব ক্ষেত্রে নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা রয়েছে।

ইসরায়েলসহ (দেশটিতে বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদের এখতিয়ার রয়েছে ধর্মীয় আদালতের হাতে) এই অঞ্চলের ১৫টি দেশের আইনে নারীরা তাঁদের স্বামীর সম্মতি ছাড়া শ্বশুরবাড়ির বাইরে যাওয়া, চাকরি বা ভ্রমণে গেলে স্বামীর কাছ থেকে তাঁদের ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারও হারাতে পারেন।

এ ছাড়া জর্ডান, কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরবের আইন তো আরও কঠোর। এসব দেশে কোনো নারী যদি বাড়ির কাউকে না বলে কোথাও যান আর পুরুষ অভিভাবক যদি এমন অভিযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে জানান, তাহলে ওই নারীকে আটক, গ্রেপ্তার বা জোর করে ফিরিয়ে আনাও ‘বৈধ’।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের (মিনা) নারীদের নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষক রোথনা বেগম বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু যে শারীরিক নির্যাতন তা কিন্তু নয়; নারীর স্বাধীন চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপও এই সহিংসতার মধ্যে পড়ে।’

রোথনা বেগম বলেন, ‘নানাভাবে বহু নারীর জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কারও ওপর যেমন কারফিউ দেওয়া আবার অনেকে কোনো একটি ক্যাফেতে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান না। এভাবে আসলে কারও পক্ষেই একটি সামাজিক জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অবসাদে ভোগার কথা বলেন অনেক নারী। কেউ কেউ এতটাই নিয়ন্ত্রিত অনুভব করেন যে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন।’

আয়ার মতো আম্মানের আরেক তরুণী লিনা। তাঁর বয়স ২৪ বছর। ঘরে বসেই একটি চাকরি করেন এই নারী। কারণ, তাঁর বাবা তাঁকে ঘরের বাইরে যেতে দেন না। যদিও পরিবারের অন্য যে কারও চেয়ে বেশি আয় করেন লিনা। মাসে ২ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার (আড়াই লাখ টাকার বেশি)। এত আয় করার পরও লিনা এ অর্থ দিয়ে কিছু করতে পারেন না। কারণ, ঘরের বাইরে যেতে না পারায় কীভাবে এই অর্থ ব্যয় করবেন তা তাঁর জানা নেই। সম্প্রতি পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হলেও লিনা তা নেননি। কারণ, নিজেকে যোগ্য মনে করছেন না তিনি।

একজন স্বাবলম্বী নারী হওয়ার পরও নিজের ঘরে এমন ‘বন্দী’ জীবনযাপন নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন লিনা। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে আমার সামাজিক যোগাযোগের ভালো দক্ষতা আছে। কারণ, আমি বাইরে যাই না, আমার ভাইদের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারি না।’

ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে পড়াশোনা করে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে লিনাকে ভর্তি হতে দেননি তাঁর বাবা। যদিও তাঁর ১৮ বছর বয়সী এক ভাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনুমতি না পেয়ে অনলাইনে পাঠদান হয় এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দিতে বাবার কাছে আকুতি জানান লিনা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান হলেও পরীক্ষার জন্য মাসে দুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীর যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত লিনা অনুমতি পান। তবে শর্ত দেওয়া হয়, বাবা তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাবেন ও নিয়ে আসবেন।

লিনা বলেন, ‘লোকজন অনেকেই হয়তো বলতে চেষ্টা করবেন, জর্ডানে এমনটা হয় না। তাঁরা বলবেন যে দেখেন, সব নারীই বাইরে বেরিয়ে আসছেন, তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপনই করছেন। কিন্তু অন্তপুরে বন্দী হয়ে থাকা যেসব নারী আমার মতো জীবনযাপন করছেন, তাঁদের আপনি দেখতে পাবেন না।’

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে নারীদের সাক্ষরতার হার সবচেয়ে বেশি জর্ডানে, প্রায় ৯৮ শতাংশ। জর্ডানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষার্থীর ৫৬ শতাংশ নারী। এর পরেও বিশ্বের যেসব দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম, তার একটি জর্ডান।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আম্মানের বাসিন্দা ২৬ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘এমন অনেক নারী আছেন যাঁরা ঘরে বন্দী থেকে তাঁদের ভাইদের বাইরে বের হতে দেখেন। আমাদের খুব অসহায় মনে হয়। মনে হয় যেন আমি আমার ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলছি। আমি জানি যে আমার জীবন স্বাভাবিক নয়। পুরো বিশ্ব গতিশীল হলেও আমি নিশ্চল।’