কয়েক দশক ধরে বেশ বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব–ইরানের কাছাকাছি আসার ঘটনায় দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সৌদি–ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে যেসব অঞ্চলে দুই দেশের ছায়াযুদ্ধ চলছিল, সেগুলো বন্ধ হওয়ায় আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইয়েমেনে ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসেছেন সৌদি কর্মকর্তারা।
আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় সৌদি ও ইরান আরও কাছাকাছি এসেছে। গত বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে বসেন। তাঁদের এ বৈঠককে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, দীর্ঘদিনের বিভেদ ভুলে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ ফয়সাল বিন ফারহানের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। ২০১৬ সালের পর প্রথমবার মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হলো। তেহরান বলেছে, চীনের মধ্যস্থতায় করা এ চুক্তির অধীন দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
আরব নিউজ বলেছে, দুই দেশের নেতাদের এই বৈঠক সম্ভাব্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নতুন পথ খুলে দিতে পারে, যা গত চার দশকের বেশি সময় ধরে দেখা যায়নি।
গত ১০ মার্চ চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তি হয়। এরপর দুই পক্ষই চুক্তির বিষয়টি দ্রুত কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেয়। এক মাসের মধ্যেই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে বসেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বৈঠক থেকেই বোঝা যায়, চুক্তির বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তাঁরা যথেষ্ট আন্তরিক। পরবর্তী করণীয় বিষয়েও সরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চুক্তির বিষয়টি আরেকটি দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চুক্তি সই হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন ইরানের সামরিক বাহিনীর একজন জেনারেল ও সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলী শামখানি ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিশ্বস্ত ও সৌদি সরকারের উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা মোসায়েদ আল–আইবান।
সাধারণত এ ধরনের চুক্তি রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছাতে হলে সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে। সমালোচকেরা বলতে পারেন, ইরানের রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছাতে এ চুক্তি হয়েছে। এতে দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই চুক্তি বাস্তবায়নে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু চুক্তি সইয়ের সময় সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতির বিষয়টি প্রমাণ করে, এখানে নিরাপত্তার বিষয়টিও গভীরভাবে খতিয়ে দেখার পর এ পথে হেঁটেছে ইরান।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সৌদি আরবের সঙ্গে এই চুক্তি ইরান টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না? এ প্রশ্নের উত্তর তেহরানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ভালো করে দিতে পারবেন। তবে অনেকেই বলতে পারেন, ইরানের সঙ্গে চুক্তি যেকোনো সময় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা নিয়ে তাদের কালক্ষেপণের ঘটনাও সবার জানা। তবে এবার সৌদির সঙ্গে চুক্তির সময় ইরানের পক্ষ থেকে কালক্ষেপণ বা গড়িমসি করার মতো কোনো আচরণ দেখা যায়নি। চুক্তিটিকে অন্য চুক্তির থেকে আলাদা করে দেখেছে তেহরান। এর পেছনে অবশ্য দুটি উল্লেখযোগ্য কারণও রয়েছে। আর সেসব কারণের একটি হচ্ছে চীন। আরেকটি হচ্ছে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ইরান বুঝতে পেরেছে, সৌদির সঙ্গে এ চুক্তিতে গেলে তারা উভয় দিক থেকেই সুবিধা নিতে পারবে।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা নিয়ে কাজ করছেন। ইরানের সঙ্গে চুক্তির আগে তাঁর দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও চুক্তির প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে যাচাই করে দেখেছে। অন্যদিকে, এ চুক্তি করতে মধ্যস্থতা করেছে চীন। এ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কোনো প্রতিফলন এ চুক্তিতে পড়বে না। বরং ইরান আরও ঘনিষ্ঠ হবে চীন ও সৌদির। ফলে তেহরান সহজে এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
এদিকে বিশ্বমঞ্চে শান্তির ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন তার উপস্থিতি জানান দিতে চাইছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে শান্তির প্রস্তাব দিয়ে সবার নজর কেড়েছে বেইজিং। পশ্চিমা বিশ্ব এ প্রস্তাবকে সন্দেহের চোখে দেখলেও রাশিয়া একে স্বাগত জানিয়েছে। ইউক্রেনও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এখন ইরান ও সৌদির মধ্যে হওয়া চুক্তি টেকসই করার বিষয়টি বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে দাবি করা চীনের সম্মানেরও একটি পরীক্ষা বটে।
আগামী ২৫ বছরে চীনের পক্ষ থেকে ইরানে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ইরানের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারও চীন। তাই বলা চলে, তেহরান চীনের মধ্যস্থতায় করা যেকোনো চুক্তি মানতে বাধ্য। পশ্চিমা কঠোর নিষেধাজ্ঞায় থাকা তেহরানের জন্য চীনের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগের পথ বেছে নেওয়ার বিকল্পও নেই। তবে কী এই চুক্তির সাফল্য নিশ্চিত?
আরব নিউজের প্রধান সম্পাদক ফয়সাল জে. আব্বাস তাঁর এক লেখায় বলেছেন, চুক্তির তিনটি দৃশ্যপট সামনে হাজির হতে পারে। একটি দিক পুরোপুরি নেতিবাচক। এ ক্ষেত্রে ইরান যদি চুক্তি মেনে না চলে, তবে আঞ্চলিক শান্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুযোগ হাতছাড়া হবে। এ ছাড়া তেহরান চীনের মতো একটি দেশকে অসন্তুষ্ট করে ফেলবে। বর্তমানে ইরানের মিত্র হিসেবে মাত্র দুটি দেশের কথা সবাই জানে। একটি হচ্ছে চীন ও অন্যটি রাশিয়া। তবে রাশিয়া এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অন্যদিকে গুরুত্ব দিতে পারছে না। বরং ইরানের কাছ থেকেও তাদের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে। ইরানি ড্রোন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করছে রাশিয়া। এখন ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে সৌদি আরব আবার আগের অবস্থানে ফিরবে। তাতে গত চার দশক ধরে ইরানের সঙ্গে দেশটির যে দূরত্ব, তা আরও বাড়বে।
চুক্তির আরেকটি দৃশ্যপট হতে পারে বাস্তব পরিস্থিতি মেনে চলা। সেটি হচ্ছে—চুক্তির বিষয়টি এগোবে, তবে ধীরগতিতে। ইতিমধ্যে উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে আগ্রাসনে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সম্মত হয়েছে। তার ফল দেখা যাচ্ছে ইয়েমেনে। ইরান–সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন সৌদি কর্মকর্তারা। বৈঠকে ছয় মাসের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। একে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে হুতিদের সঙ্গে সৌদির বৈঠককে সৌদি–ইরান চুক্তির ফল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। হুতিদের সংবাদ সংস্থা সাবার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দুই পক্ষের এ আলোচনা রিয়াদ ও সানার মধ্যে সম্পর্কে ইতিবাচক উন্নয়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দুই দেশ চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হওয়ায় রিয়াদ ও সানার আলোচনাও গতি পেয়েছে।
ইয়েমেন সরকারকে হটিয়ে ২০১৫ সাল থেকে সানার নিয়ন্ত্রণ নেয় হুতি বিদ্রোহীরা। এরপরই হুতি ও সরকারকে সমর্থনকারী সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
গত শনিবার সৌদি ও ওমানের প্রতিনিধিদল সানায় হুতি সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মাহদি আল-মাশাতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁরা বৈঠকে শত্রুতার অবসান ও ইয়েমেনের বন্দরগুলো থেকে সৌদি অবরোধ তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। মাহদি আল-মাশাত বলেন, হুতি আন্দোলনকারীরা সম্মানজনক শান্তি চায়। আর ইয়েমেনিদের চাওয়া মুক্তি ও স্বাধীনতা। ইয়েমেনে জাতিসংঘের দূত হ্যান্স গ্রুন্ডবার্গ বলেন, দীর্ঘস্থায়ী শান্তির দিকে বাস্তব অগ্রগতির কাছাকাছি চলে গেছে ইয়েমেন।
মধ্যপ্রাচ্যে দুই আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে চীনের মধ্যস্থতায় হওয়া চুক্তির আওতায় তেহরানে দূতাবাস ও মাশহাদে কনস্যুলেট খোলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইতিমধ্যে রিয়াদে তেহরানের দূতবাস খোলা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক দূতাবাসগুলো নতুন করে চালু হলে উভয় পক্ষই সরাসরি কথা বলার ও কূটনৈতিক পথে যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে। এতে সংশ্লিষ্ট সরকারের পক্ষে স্থিতিশীলতা অর্জন সহজ হবে। এর সম্ভাব্য ফল ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়ায় দেখা যাবে।
ইরান–সৌদি চুক্তির সবচেয়ে ইতিবাচক আরেক দৃশ্যকল্প হতে পারে—মধ্যপ্রাচ্যের সব সংকটে সমাধান হয়ে যাওয়া। এর মধ্যে ইরাক, লেবানন ও সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে এসব দেশে ইরানের যে বিনিয়োগ ও স্বার্থ রয়েছে, তাতে ইরান কতটা ছাড় দেবে, সে প্রশ্ন থাকছেই।
তবে সবদিক বিবেচনা করলে এ চুক্তিতে সৌদি জিতেছে, তা বলা চলে। বিশেষ করে ইরানকে সঙ্গে নিয়ে সৌদি নিজের নিরাপত্তার পাশাপাশি, আঞ্চলিক স্থিতিশীলত, বৈশ্বিক বাজার ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে হাঁটতে পারে।
তথ্যসূত্র : আরব নিউজ, রয়টার্স, এএফপি