উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের লোকজনকে ওদ নামের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোনাচ্ছেন ফিলিস্তিনি কিশোর ইউসেফ সাদ
উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের লোকজনকে ওদ নামের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শোনাচ্ছেন ফিলিস্তিনি কিশোর ইউসেফ সাদ

যুদ্ধের বিভীষিকা ভোলাতে শিশুদের গান শোনায় গাজার এই খুদে বাদ্যশিল্পী

গাজার ১৫ বছর বয়সী কিশোর ইউসেফ সাদ। ইসরায়েলের বিমান হামলা ও বোমা বিস্ফোরণের ক্রমাগত ঝুঁকি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন সাইকেলে চেপে উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে খুদে এই বাদক। এ সময় পিঠে ঝোলানো থাকে ওদ নামে তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটি।

গাজায় ১১ মাস ধরে চলা যুদ্ধে প্রতিদিনই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে সেখানকার শিশুরা। তাদের গান শুনিয়ে আনন্দ দেওয়ার ও যুদ্ধের বিভীষিকা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউসেফ সাদ।

‘আমার এই শহরের বাড়িগুলো একসময় স্বপ্নে ভরপুর ছিল। এখন সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে’—কয়েক দশকের পুরোনো জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের ধ্বংসস্তূপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল কিশোর সাদ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শিবিরটি স্থাপন করা হয়; যা খুবই ঘনবসতিপূর্ণ।

গাজার প্রতিটি ঘরেই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা আছে। কেউ মা হারিয়েছে, কেউ বাবা, কেউ প্রতিবেশী অথবা কেউ বন্ধু।
ইউসেফ সাদ, গাজার খুদে বাদ্যশিল্পী

গাজা সিটির কাছে অবস্থিত এডওয়ার্ড সাইদ ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব মিউজিকে পড়াশোনা করত সাদ। ইসরায়েলের হামলায় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে গেছে। পুরো গাজা উপত্যকাই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।

ইসরায়েলি সেনাদের তাণ্ডবে ইউসেফ সাদের বাড়িও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ফলে এখন অন্য স্বজনদের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে তাকে। সাদের ভাইবোন পাঁচজন। তাদের সবার জীবনই ওলট–পালট হয়ে গেছে।

নিজ বাড়ির ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে আছে ফিলিস্তিনি কিশোর ইউসেফ সাদ। ওদ নামের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার শিশুদের উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করে সে

খুদে এ বাদকের বাবা ফিলিস্তিনের সরকারি কর্মকর্তা। তিনি সাদের বাদ্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্নকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। তবে এখন সাদের মনোযোগ অন্যদিকে। জাবালিয়া দিবাকেন্দ্রে গাজার যুদ্ধে আতঙ্কগ্রস্ত শিশুদের জন্য গান গেয়ে ও ওদ বাজিয়েই দিন কাটে তার।

বিপদ সত্ত্বেও সাদ তার কাজ চলিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অটল। সে বলেছে, আমরা তাদের (শিশুদের) মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এমনকি এ জন্য আমার নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতেও হতে পারে। শিশুদের প্রতি এটি আমার কর্তব্য।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কয়েক দশকের পুরোনো সংঘাতে সর্বশেষ রক্তপাতের সূত্রপাত হয় গত বছরের ৭ অক্টোবর। ইসরায়েলের হিসাব অনুযায়ী, সেদিন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের ইসরায়েলে হামলায় নিহত হন প্রায় ১ হাজার ২০০ জন। এ ছাড়া হামাসের যোদ্ধারা প্রায় আড়াই শ জনকে জিম্মি করেন।  

হামাসের হামলার জবাবে ওই দিন থেকে গাজায় তাণ্ডব চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত ৪০ হাজার ৮০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাই এক বা একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

সাদ বলে, ‘গাজার প্রতিটি ঘরেই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা আছে। কেউ মা হারিয়েছে, কেউ বাবা, কেউ প্রতিবেশী অথবা কেউ বন্ধু।’

বিপদ সত্ত্বেও সাদ তার কাজ চলিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অটল। সে বলেছে, ‘আমরা তাদের (শিশুদের) মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সাহায্য করার চেষ্টা করছি। এমনকি এ জন্য আমার নিজের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতেও হতে পারে। শিশুদের প্রতি এটি আমার কর্তব্য।’

গাজায় ইসরায়েলের হামলায় পা হারানো এক ফিলিস্তিনি শিশু

ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখা থেকেও পিছপা হবে না সাদ। তার কথায়, ‘আমরা ফিলিস্তিনি শিশুরা গণহত্যার মুখে দাঁড়িয়েও শক্ত ও প্রাণবন্ত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

সাদ আরও বলেছে, একটি কথা তাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। তা হলো, ‘বাঁচলে মুক্তভাবে বাঁচো, নয়তো গাছের মতো দাঁড়িয়ে মরো।’