আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) সামনে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ। এ আদালতেই চলছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার শুনানি। গতকাল নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) সামনে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ। এ আদালতেই চলছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার শুনানি। গতকাল নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে

ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আইসিজের সামনে বিক্ষোভ

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) সামনে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে এই আদালতেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যা মামলার শুনানি চলছে। গতকাল শুক্রবার শুনানির দ্বিতীয় দিনে আদালতের বাইরের অংশ ছিল বিক্ষোভকারীদের ‘মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী’ ধ্বনিতে উত্তাল।

এদিকে গতকালই ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর লোহিত সাগর দিয়ে চলাচলকারী বেশ কয়েকটি জাহাজ হুতিদের হামলার শিকার হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ওই হামলা চালানো হয়। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে।

গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আইসিজেতে চলছে দুদিনের শুনানি। প্রথম দিনে গত বৃহস্পতিবার নিজেদের অভিযোগের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবীরা। আর গতকাল দ্বিতীয় দিনের শুনানিতে ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা বলেছেন, আইসিজেতে আনা অভিযোগ মিথ্যা।

আদালতের বাইরে গতকালের শুনানি সম্প্রচার করা হচ্ছিল বিশাল এক পর্দায়। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যেই সেখানে ছিল নারী–পুরুষ থেকে বৃদ্ধ–শিশু—হাজারো মানুষের সমাগম। তাঁদের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা আর গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে লেখা প্ল্যাকার্ড। শুনানিতে ইসরায়েলি পক্ষ যখন যুক্তি উপস্থাপন করছিল, ফিলিস্তিনের এই সমর্থকেরা স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘আমরা তোমাদের (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনছি।’

এই বিক্ষোভকারীদের একজন নিন হাইজ্জায়ি। সম্প্রতি ফিলিস্তিন থেকে নেদারল্যান্ডসে আসা এই তরুণীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, শুনানিতে ইসরায়েল দাবি করেছে, আত্মরক্ষার জন্য গাজায় হামলা চালাচ্ছে তারা। এ নিয়ে তিনি কী ভাবছেন? জবাবে নিন হাইজ্জায়ির উল্টো প্রশ্ন, ‘দখলদার একটি দেশ ৭৫ বছর ধরে (ফিলিস্তিনের) মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। তারা কীভাবে নিজেদের আত্মরক্ষার কথা বলে?’

এদিকে আইসিজের বাইরে সমবেত হয়েছিলেন ইসরায়েলের সমর্থকেরাও। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের পরিবারের সদস্যরা। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে তাঁদের জিম্মি করেছিল হামাস। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার ৭০৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার আহ্বান খারিজের আবেদন

আইসিজেতে উত্থাপন করা মামলার শুনানিতে বৃহস্পতিবার বিচারকদের প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবীরা আহ্বান জানান, গাজায় ইসরায়েলের হামলা অবিলম্বে বন্ধে তাঁরা যেন জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেন। তবে গতকাল শুনানিতে ওই আহ্বান খারিজ করার আবেদন করে ইসরায়েল বলেছে, এমনটা করা হলে তারা প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়বে।

মামলার শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগ—ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে গাজা উপত্যকা গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা ছিল। তবে গতকাল যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা টাল বেকার আদালতে বলেন, গাজার ঘটনা ‘ব্যাপকভাবে বিকৃত’ করে উপস্থাপন করছে দক্ষিণ আফ্রিকা।

ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও গতকাল শুনানিতে টাল বেকার বলেন, ‘যদি গণহত্যার কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঘটানো হয়েছে। ইসরায়েলে গণহত্যা করতে চাইছে হামাস।’ ইসরায়েলের নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তাঁদের লড়াই হামাসের বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসিদের হাতে ইহুদি নিধনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালে গণহত্যাবিষয়ক সনদ প্রণয়ন করা হয়। ওই সনদ অনুযায়ী কোনো জাতি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বর্ণ অথবা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে ঘটানো কর্মকাণ্ডই গণহত্যা। এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ ইসরায়েল। তাই দেশটির গণহত্যা প্রতিহত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

দুই দিনের শুনানি শেষে চলতি মাসের শেষের দিকে জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারে আইসিজে। তবে গণহত্যার অভিযোগের বিচার শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আইসিজে যে রায় দেন, তার বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। তবে ওই রায় মানতে বাধ্য করার এখতিয়ার নেই আদালতটির।

ইয়েমেনে হামলায় বেড়েছে তেলের দাম

গাজা সংঘাত শুরুর পর থেকেই ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে আসছে ইরানপন্থী হুতি বিদ্রোহীরা। সম্প্রতি লোহিত সাগরে ইসরায়েল–সংশ্লিষ্ট কয়েকটি জাহাজে হামলা চালায় তারা। এর জেরে হুতিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

সেই হুঁশিয়ারি সত্যি করে গতকাল ভোরে ইয়েমেনে হুতিদের ১৬টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এই পদক্ষেপের ফলে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করা যাবে। অপরদিকে হামলার পর হুতিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর জন্য ওয়াশিংটন ও লন্ডনকে চরম মূল্য দিতে হবে।

এদিকে গতকালের হামলার পর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম ব্যারেলে ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে ৭৯ দশমিক ২৫ ডলার হয়েছে। অন্যদিকে ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ২ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে ৭৩ দশমিক ৮৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে।