ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সশস্ত্র সংগঠন হামাস। সম্প্রতি ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে বিশ্বজুড়ে আবারও আলোচনায় এসেছে সংগঠনটি। বলা হচ্ছে, নিখুঁত পরিকল্পনা ও মাত্রা বিবেচনায় নিলে হামাসের আগের হামলাগুলোর চেয়ে এবারেরটি ছিল একেবারে ব্যতিক্রম।
গত শনিবারের ওই হামলার পরই হামাসের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বছরের পর বছর সামরিক প্রশিক্ষণ পাওয়া হামাস যোদ্ধাদের মোকাবিলায় ইসরায়েলের সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়ন্দা সংস্থাগুলো এর আগে কখনো এতটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি।
কীভাবে হামাস এমন সামরিক সক্ষমতা অর্জন করল—জানতে চাইলে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ নেতা আলী বারাকা বলেন, ‘প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক’। ইরান ও ইরানের আঞ্চলিক সহযোগী, যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহসহ অনেকেই হামাসকে অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে বলে জানালেন তিনি।
গত এক দশকে হামাস কীভাবে তাদের সামরিক শক্তি বাড়াল, সেসব বিষয়েও জানালেন বারাকা। অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতার বিষয়টি উল্লেখ করে বর্তমানে লেবাননে অবস্থানরত বারাকা জানালেন, হামাস এখন নিজেরাই স্থানীয়ভাবে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক তৈরি করতে পারে।
২০০৮ সালে গাজা যুদ্ধের সময় হামাস যেসব রকেট ব্যবহার করত, সেগুলো সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারত। আলী বারাকা জানালেন, ২০২১ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের সময়ে হামাসের রকেটের পাল্লা বেড়ে হয় ২৩০ কিলোমিটার।
সামরিক দিক বিবেচনায় হামাস বর্তমানে কতটা শক্তিশালী—এ বিষয়ে জানতে ১১ জনের সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এসব ব্যক্তির মধ্যে হামাসের একাধিক যোদ্ধা যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও সামরিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও।
হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন একটি সূত্রের মতে, সেখানে (গাজা উপত্যকা) একটি সেনাবাহিনীর আদলে একটি যোদ্ধা দল আছে। সেখানে হামাসের একটি মিলিটারি একাডেমি রয়েছে। ওই একাডেমিতে ৪০ হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত হামাসের সামরিক শাখার যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাইবার নিরাপত্তার মতো বিশেষায়িত বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একটি নৌ কমান্ডো ইউনিটও আছে।
বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংগঠন গ্লোবাল সিকিউরিটির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের দিকে হামাসের যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের কম।
আরেকটি সূত্র বলছে, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল—এই সময়ে গাজার নিচে একটি সুড়ঙ্গ খনন শুরু করে হামাস। লক্ষ্য ছিল, হামাস যোদ্ধারা এই সুড়ঙ্গে ধীরে ধীরে আশ্রয় নিতে পারেন। এ ছাড়া সুড়ঙ্গ খনন করার আরেকটি লক্ষ্য ছিল, অস্ত্র তৈরির কারখানা নির্মাণ ও বাইরে থেকে আসা অস্ত্র সেখানে রাখা।
হামাস কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনটির কাছে বর্তমানে অনেক ধরনের বোমা, বিস্ফোরক, মর্টার, রকেটের পাশাপাশি ট্যাংকবিধ্বংসী ও বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা জিউইশ ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি অব আমেরিকার তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২১ সালের গাজা যুদ্ধের সময় হামাস ও তাদের সহযোগী সংগঠন প্যালেস্টানিয়ান ইসলামিক জিহাদের সংগ্রহে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে।
প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের গাজা যুদ্ধের আগে যেখানে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ছিল ২৩ হাজার, সেখানে গত যুদ্ধের পর সংখ্যাটা আনুমানিক ১১ হাজার ৭৫০–এ নেমে এসেছে।
গত বছর আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসকে ইরানের সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছিলেন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ে। তিনি জানান, ইরান হামাসকে সাত কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে। ইসমাইল হানিয়ে বলেন, ‘আমাদের কাছে রকেট আছে, যা আমরা নিজেরাই তৈরি করি। কিন্ত দূরপাল্লার রকেট আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। মূলত মিসর হয়ে ইরান ও সিরিয়া থেকে।’
২০০৫ সাল ইসরায়েল গাজা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর থেকেই মূলত হামাস রকেট, বিস্ফোরক ও অন্য সামরিক সরঞ্জাম আমাদানি শুরু করে বলে জানান পশ্চিমা গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, সুদান থেকে এসব অস্ত্র আসে। এরপর ট্রাকে করে মিসরে নেওয়া হয়। পরে মিসরের সিনাই উপদ্বীপের একটি সরু সুড়ঙ্গের মাধ্যমে সেগুলো গাজাতে নেওয়া হয়।
হামাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ওই সূত্র বলছে, ১৯৯২ সালে ইসরায়েল যখন প্রায় ৪০০ হামাস নেতাকে লেবাননে পাঠিয়ে দেয়, সেই সুযোগ নেয় ইরান। হামাসের ঘনিষ্ঠ হতে থাকে তেহরান। ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাস সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া তাদের সঙ্গে সামরিক প্রযুক্তি ও আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য হাতে তৈরি বোমা বানানো নিয়েও তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তিন বছর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোকে বছরে ১০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা হিসেবে দিয়ে থাকে ইরান। তবে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত বছর থেকে সেটা বেড়ে ৩৫ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ সহযোগী ফেলো এইচ এ হেলার। তিনি বলেন, গত শনিবার ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর এর জবাবে বিমান থেকে গাজায় বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এখন ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ জনবহুল গাজায় সেনা পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এভাবে সেনা পাঠিয়ে হামাসকে নির্মূল করার সক্ষমতা হয়তো ইসরায়েলের আছে।
এইচ এ হেলার বলছেন, (ইসরায়েলের) সক্ষমতা রয়েছে কি না, সেটা নয় বরং প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরায়েল স্থল অভিযান চালালে গাজার অন্য বাসিন্দাদের এর কতটা চড়া মূল্য দিতে হবে। এর কারণ, হামাস তো কোনো মহাসাগরের এক দ্বীপে অথবা মরুভূমির কোনো এক গুহায় থাকে না।