হামাসের রকেট রুখতে যে অস্ত্র ব্যবহার করছে ইসরায়েল

২০১১ সালে ইসরায়েল প্রথম আয়রন ডোম মোতায়েন করে
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর ইসরায়েল যুদ্ধে নেমেছে।

দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী এই সংঘাতের সূত্রপাত হয় গতকাল শনিবার সকালে। এদিন সকালে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলে মুহুর্মুহু রকেট হামলা চালানো হয়।

হামাস ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় মাত্র ২০ মিনিটে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়ে। হামাস ইসরায়েলে চালানো এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’।

হামাসের রকেট হামলার জেরে ইসরায়েলজুড়ে আকাশপথে হামলার সতর্কসংকেত (সাইরেন) বাজানো হয়। এই সতর্কসংকেতের শব্দে ইসরায়েলে সকালের নীরবতা ভাঙে।

একই সঙ্গে ইসরায়েলে আবার সক্রিয় হয় ‘আয়রন ডোম’। ‘আয়রন ডোম’ বিশ্বের অন্যতম সেরা ও অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

হামাসের ছোড়া রকেট মাঝ আকাশে ধ্বংস করতে থাকে ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’। একের পর এক রকেট ধ্বংসের ফলে আকাশ অগ্নিশিখায় আলোকিত হয়। আকাশে তৈরি হয় এক নাটকীয় দৃশ্য।

তবে এবার হামাসের রকেট হামলার মাত্রা ছিল নজিরবিহীন। তাই গাজা থেকে ছোড়া অনেক রকেট ইসরায়েলের আয়রন ডোমের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়। এ কারণে ইসরায়েলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাসের হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় গাজায় ২৩০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। উভয় পক্ষে আহত হয়েছেন হাজারো মানুষ।

আয়রন ডোম কী

এনডিটিভি জানায়, আয়রন ডোম হলো ভূমি থেকে আকাশে ছোড়ার একটি স্বল্পপাল্লার (শর্ট রেঞ্জ) আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।

স্বল্পপাল্লার রকেট, মর্টার, আর্টিলারি শেল ও ড্রোন হামলা মোকাবিলায় ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে আয়রন ডোম মোতায়েন আছে।

ইসরায়েলের এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার পরিসীমা প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এই ব্যবস্থায় তিনটি কেন্দ্রীয় উপাদান আছে, যা নিয়ে একটি আয়রন ডোম ইউনিট গঠিত।

আয়রন ডোম ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় উপাদান তিনটি হলো—রাডার ব্যবস্থা (ডিটেকশন-ট্র্যাকিং রাডার), কন্ট্রোল ব্যবস্থা (ব্যাটল ম্যানেজমেন্ট-উইপনস কন্ট্রোল) ও মিসাইল ফায়ারিং ব্যবস্থা। প্রতিটি মিসাইল ফায়ারিং ব্যবস্থায় ২০টি তামির ক্ষেপণাস্ত্র থাকে।

২০২১ সালে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস ও ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ আয়রন ডোম তৈরি করেছে। আয়রন ডোম তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও কিছু সহায়তা পেয়েছে ইসরায়েল।

এনডিটিভি জানায়, আয়রন ডোম তৈরির প্রেক্ষাপট ২০০৬ সালে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহ হাজারো রকেট হামলা চালায় ইসরায়েলে। হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ইসরায়েলের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

হিজবুল্লাহর সঙ্গে এই যুদ্ধের পর ইসরায়েল ঘোষণা দেয়, তারা একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাচ্ছে। ২০১১ সালে ইসরায়েল প্রথম আয়রন ডোম মোতায়েন করে।

আয়রন ডোম কীভাবে কাজ করে

ইসরায়েলের দিকে ধেয়ে আসা রকেটকে চিহ্নিত ও তার গতিপথ শনাক্ত করে আয়রন ডোমের রাডারব্যবস্থা। এই তথ্য অস্ত্র নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় পাঠানো হয়। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রকেটের গতিপথ, গতি ও সম্ভাব্য নিশানা দ্রুত শনাক্ত করে।

যদি ধেয়ে আসা রকেট জনবহুল এলাকা বা কৌশলগত স্থাপনার দিকে যেতে থাকে, তাহলে আয়রন ডোমের লঞ্চার স্বয়ংক্রিয়ভাবে তামির ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এই ক্ষেপণাস্ত্র আকাশেই ধেয়ে আসা রকেটকে ধ্বংস করে।

ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমসের দাবি, আয়রন ডোমের সাফল্য ৯০ শতাংশ। এই ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি রকেট আকাশে ঠেকিয়ে দিয়েছে।

এবার কী হলো

আয়রন ডোমকে প্রায় নিখুঁত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মনে করা হচ্ছিল। হামাসের ছোড়া রকেট ঠেকানোর ক্ষেত্রে আয়রন ডোমকে অপ্রতিরোধ্য মনে করা হচ্ছিল।

তবে কয়েক বছর ধরে আয়রন ডোমের দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে আসছিল হামাস। এ ক্ষেত্রে তারা অল্প সময়ের মধ্যে মুহুর্মুহু রকেট ছুড়ে এই ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে অনেকাংশে সফল হয়েছে। এই যেমন এবার মাত্র ২০ মিনিটে ৫ হাজারের বেশি রকেট ছোড়ে হামাস। যার ফলে সব রকেট ঠেকাতে ব্যর্থ হয় আয়রন ডোম।

হামাস ক্রমাগত তার রকেট প্রযুক্তির উন্নয়ন করে চলছে। কয়েক বছর ধরে তারা তেল আবিব, জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বড় শহরগুলোতে আঘাত হানার জন্য রকেটের হামলার পরিসর বাড়িয়েছে।

২০১২ সালে হামাসের সঙ্গে সংঘাতের সময় ইসরায়েল দাবি করেছিল, গাজা থেকে বেসামরিক ও কৌশলগত এলাকাগুলোর দিকে ছোড়া ৪০০টি রকেটের মধ্যে ৮৫ শতাংশই তারা প্রতিহত করেছে।

২০১৪ সালের সংঘাতে কয়েক দিনে ৪ হাজার ৫০০টির বেশি রকেট ছুড়েছিল হামাস। তখন ইসরায়েলে দাবি করেছিল, আয়রন ডোম ৯০ শতাংশ রকেট ঠেকিয়ে দিয়েছে।

আয়রন ডোমের উন্নতি ও ২০২১ সালের সংঘাত

২০২১ সালে ইসরায়েল বলেছিল, তারা অতিরিক্ত হুমকি মোকাবিলা করার জন্য আয়রন ডোম ব্যবস্থার সক্ষমতার উন্নতি করেছে।

২০২১ সালের মে মাসে দুই সপ্তাহব্যাপী ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত হয়। এই সংঘাতের প্রাথমিক দিনগুলোতে এক হাজারের বেশি রকেট ছোড়ে হামাস। আর পুরো সংঘাতকালে তারা ৪ হাজার ৫০০টির বেশি রকেট ছোড়ে।

সে সময় ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছিলেন, হামাসের ছোড়া রকেটের বিরুদ্ধে আয়রন ডোম ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে।