গাজায় হামলা থামাতে ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়ছে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মঙ্গলবার ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছেন, গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন কমতে শুরু করেছে। এর পর থেকে ইসরায়েলের মিত্রদের অনেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ অন্যান্য মিত্রদেশ এক বিরল যৌথ বিবৃতিতে শত্রুতার অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি দেশগুলো গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য নিরাপদ এলাকা কমে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মঙ্গলবার গাজায় যুদ্ধবিরতি চেয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ১৯৩ সদস্যের মধ্যে ১৫৩ দেশ ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও অন্য আটটি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। সমর্থন অব্যাহত রাখলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দুই মাসের বেশি সময় আগে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এবারই প্রথম প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন।

মঙ্গলবার নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের এক প্রচার সমাবেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, (ইসরায়েলের) প্রতি বিশ্বের অধিকাংশের সমর্থন ছিল। কিন্তু নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে তারা সেই সমর্থন হারাতে শুরু করেছে।

গাজায় অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে উল্লেখ করে সেখানকার বেসামরিক নাগরিক হতাহত এড়িয়ে যেতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে ওয়াশিংটন।

কট্টরপন্থী

ইসরায়েলের সরকারকে কট্টরপন্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র দেখছে, সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন জো বাইডেন। তিনি উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্ষণশীল এই সরকার এ সংঘাতের সমাধানকে কঠিন করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল

ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন–গভিরের নাম উল্লেখ করে বাইডেন বলেছেন, তাঁকে (ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু) সরকারে পরিবর্তন আনতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন যে ইসরায়েল একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিষয়ে ‘না’ বলতে পারে না। ইসরায়েল সরকারের যাঁরা দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রস্তাব নাকচ করছেন, তাঁদের মধ্যে বেন–গভিরের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি।

গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত তিন ফিলিস্তিনি শিশুর মরদেহ দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা

যুদ্ধ শেষে কীভাবে গাজায় শাসন চলবে, সে বিষয়ে বাইডেনের সঙ্গে মত ভিন্নতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু।

ইসরায়েলি সরকার গাজা থেকে সব জিম্মি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেছে। অবশ্য তেল আবিব প্রশাসনের কিছু সদস্য স্বীকার করেছেন যে চলমান এই অভিযানের বৈধতা দিকটি শেষ হয়ে যেতে পারে।

চলতি সপ্তাহেই ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানকে পাঠাচ্ছে হোয়াইট হাউস। এ বিষয়ে বাইডেন বলেছেন, জ্যাক সুলিভানের এই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলের পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়েও জোর দেওয়া হবে।

তবে এরপরও বিশ্লেষকদের মতে, গাজায় প্রাণহানি ঠেকাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাইডেনের আরও বেশি কিছু করা উচিত। এ বিষয়ে আল–জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেছেন, ইসরায়েলের ভেতরে বাইডেন নেতানিয়াহুর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নেতানিয়াহুর ওপর বেশির ভাগ ইসরায়েলির আস্থা নেই।

বিশারার মতে, অবিলম্বে মানবিক সহায়তার জন্য যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নসহ গাজা নিয়ে ইসরায়েলের অবস্থান পরিবর্তনে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাইডেনের জন্য এখনই উপযুক্ত সময়।  তিনি বলেন, নেতানিয়াহু যদি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে বাইডেনের উচিত হবে তাঁর থেকে সমর্থন সরিয়ে নেওয়া।

এ বিষয়ে জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ চেকাউই বলেছেন, বাইডেন আর ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের পক্ষে নেই। বিশেষত এমন ব্যক্তির সরকারে থাকা উচিত নয় বলে তিনি যখন ইতামার বেন–গভিরের নাম উল্লেখ করেন, তখন সেটি স্পষ্ট হয়।

মোহাম্মদ চেকাউইয়ের মতে, হামাস নির্মূলের লক্ষ্য অর্জনে ইসরায়েলের সুস্পষ্ট কৌশল না থাকা এবং গাজায় নিহতের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়ে তা বাড়তে থাকায় বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘শেষ সীমায়’ পৌঁছে গেছে। তিনি বলেন, ‘নেতানিয়াহু যদি তার সামরিক অভিযান সম্পূর্ণ করতে আরও দুই মাস ডিসেম্বর ও জানুয়ারি তা চালিয়ে নিতে চান, তাহলে তা এত বেশি সময় চালানো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। সে ক্ষেত্রে আমরা সম্ভবত ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগে এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্র চাপ প্রয়োগ করছে, তা দেখতে পারি।’

দুর্ভোগ চলমান

ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই তিন দেশের নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, হামাসকে পরাজিত করার বিনিময়ে ফিলিস্তিনের সব বেসামরিকের চলমান দুর্ভোগ চলতে পারে না।

বিশ্বের ১৩৫ কোটি মানুষের ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসও বুধবার আবারও গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় দেশের নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘবের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বহু ভবন

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ইসরায়েলি বাহিনী গত ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু এবং প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা আরও অনেকর মৃত্যু তথ্য এই হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে।

গাজা নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসের সদস্যরা ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা এবং সেখান থেকে প্রায় ২৪০ জনকে ধরে এনে জিম্মি করেন। এর প্রতিক্রিয়া গাজায় ওই হামলা শুরু করে ইসরায়েল।