গত ৫ মাসে ১৭ হাজার মানুষকে দাফন করেছেন আবু জাওয়াদ
গত ৫ মাসে ১৭ হাজার মানুষকে দাফন করেছেন আবু জাওয়াদ

ইসরায়েলিদের হাতে নিহতদের দাফন করে প্রতিদিন তাঁর হৃদয় ভেঙে যায়

সাদি হাসান সুলাইমান বারাকা, ডাকনাম আবু জাওয়াদ। গত ৭ অক্টোবরের আগে তাঁর দিন শুরু হতো নিয়মিত ছন্দে। তিনি জলপাইয়ের তেলেমাখা দুকা আর জাতারের চাটনিসহযোগে নাশতা সারতেন। তারপর দেইর–আল-বালাহর পূর্ব দিকে তাঁর পাম ও জলপাইগাছগুলোর পরিচর্যা করতে যেতেন।

৬৪ বছর বয়সী আবু জাওয়াদ পেশায় মুর্দাফরাশ। ইসরায়েল ৭ অক্টোবর গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার কয়েক দশক আগে থেকে তিনি মরদেহ দাফনের শেষ কাজগুলো করে আসছেন। ১০ সন্তানের বাবা ও ১১৬ নাতি-নাতনির দাদা-নানা জাওয়াদকে এখন প্রতিদিন এই কাজে নিরন্তর ব্যস্ত থাকতে হয়। এক দিনে এত মানুষকে দাফন করা যে সম্ভব, তা তিনি আগে কল্পনাও করতে পারেননি।

প্রশান্তি হারিয়ে গেছে

আবু জাওয়াদ গাজার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত দেইর-আল-বালাহ শরণার্থীশিবিরের প্রথম দিকের বাসিন্দাদের একজন। সেখানে ছোট একটি বাড়িতে স্ত্রী ও ১০৪ বছর বয়সী মাকে নিয়ে থাকেন। সাদাসিধে, প্রাণবন্ত ও দয়ালু আবু জাওয়াদ ‘দেইর-আল-বালাহর হৃৎস্পন্দন’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর নিরিবিলি জীবনে ছন্দপতনের সুগভীর আঘাত তিনি নিজের মনে আর দেহে প্রতিনিয়ত টের পান।

ইসরায়েলি হামলায় নিহত ছেলেকে দাফন করা হয়েছে। ছেলের কবরের পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা। খান ইউনিস, দক্ষিণ গাজা, ১৮ জানুয়ারি

আবু জাওয়াদ বলেন, ‘আমার ওজন ৩০ কেজি কমে গেছে। দাফনের পালা শেষ হওয়ার পর আমি রাতে ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না। আমি যেসব দৃশ্য দেখি…একেবারে বিভীষিকা। কিছুতেই তারা আমার মন থেকে যায় না।’

‘আমার ২৭ বছরের পেশাজীবনে যত দাফন করেছি, তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি মানুষকে কবর দিয়েছি এই যুদ্ধের সময়। প্রতিদিনের হিসাবে সবচেয়ে কম ছিল ৩০ জন এবং সবচেয়ে বেশি ছিল ৮০০ জন’, বলেন আবু জাওয়াদ।

আমরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি। এখানে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। পানি, খাবার, বিদ্যুৎ বা শান্তি—কিছুই নেই। এটা কি কোনো জীবন?
আবু জাওয়াদ

‘গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে এযাবৎ ১৭ হাজারের বেশি মানুষকে কবরে শুইয়েছি আমি। প্রিয়জনের কবর এবং দাফনের অপেক্ষায় থাকা মরদেহ ঘিরে ক্রন্দনরত স্বজনদের ভিড়ে প্রতিদিন কবরস্থান ভরে থাকে।’

আবু জাওয়াদ বলেন, ‘এখন এটাই আমার জীবন। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, কখনো আরও বেশি সময় ধরে আমি কবরস্থানে কাজ করি। আমি কাফনের কাপড় গোছাই, কবর খুঁড়ি, জানাজা পড়াই, শোক করি ও দাফন করি।

‘খান ইউনিস থেকে বাস্তুচ্যুত চারজন এই কাজে আমাকে সহযোগিতা করেন। এটা আমাদের স্বেচ্ছাশ্রম। এ জন্য আমাদের ত্রাণ, খাবার ও টাকা দিতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা কেবল আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার এবং শহীদদের জন্য ক্ষমা ছাড়া আর কিছুই চাই না। দেইর–আল–বালাহতে দুটি কবরস্থান আছে। এর মধ্যে একটি পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। অন্যটিতেও কবরের জায়গা শেষ হয়ে আসছে।’

‘আমরা মৃত’

গত বছরের নভেম্বরে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি শুরুর দিনটিতে ৮০০ জনকে কবর দেওয়ার কথা মনে আছে আবু জাওয়াদের। তাঁদের বেশির ভাগই শিশু।

আবু জাওয়াদ বলেন, ‘আমরা তাঁদের ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পেয়েছিলাম। দেহগুলো একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, মনে হয় যেন ইসরায়েলের স্নাইপাররা এই মানুষদের তাঁদের নিশানা শেখার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন।’

ইসরায়েলের বোমা হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়ে শিশুসন্তান নিয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছেন এই ফিলিস্তিনি নারী। আল-শিফা হাসপাতাল, গাজা

আবু জাওয়াদ বলেন, ‘সাধারণত আমরা কাফনের ওপর মৃত ব্যক্তির নাম লিখে রাখার সুযোগ পাই এবং তাঁদের প্রিয়জনেরা এসে তাঁদের জন্য দোয়া করতে পারেন। কিন্তু সেই ৮০০ জনকে দেখতে আসার জন্য কোনো প্রিয়জনও ছিল না।’ কষ্টের সে কথা মনে করতে গিয়ে আবু জাওয়াদের স্বর বন্ধ হয়ে আসে।

‘আমার কাছে মনে হয়, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরাই এখনো বেঁচে আছেন, আর আমরা মৃত। কারণ, আমরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি। এখানে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। পানি, খাবার, বিদ্যুৎ, শান্তি—কিছুই আর নেই। এটা কি কোনো জীবন? প্রায় প্রতিদিনই আমি অনেককে দেখি, যাঁরা তাঁদের প্রিয়জনের কবর ছেড়ে যান না। আমি চলে যাই; ফিরে এসে দেখি, তাঁরা তখনো তাঁদের অপূরণীয় ক্ষতির জন্য ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছেন।

একটি পরিবারের পক্ষে স্বজনের মরদেহ কবরস্থানে নিয়ে আসা সহজ কোনো কাজ নয়। মরদেহ নিয়ে রাস্তায় বের হতে না পেরে বাড়ির উঠানে দাফন করার অনেক খবর পাওয়া গেছে।

আবু জাওয়াদ আরও বলেন, প্রিয়জনকে কবরস্থানে নিয়ে আসতে পরিবারগুলোর কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়। কখনো বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ বের করার জন্য কোনো হাতিয়ার থাকে না। কখনো মরদেহ মুড়িয়ে আনার মতো কাফন বা কোনোরকম আচ্ছাদন জোটে না।

‘প্রতিদিন যে মাত্রার বিনাশ, ক্ষয়ক্ষতি ও বিভীষিকা দেখি, সেটা সত্ত্বেও আমি (এই কাজ থেকে) বিরত হতে পারি না। কখনো হবও না। এই গণহত্যা বন্ধ করুন! আমরা শান্তিতে বাঁচতে শান্তিপূর্ণ জীবন চাই। আমি প্রতিদিন এখান থেকে বেরিয়ে নিরাপদে বাড়িতে ফিরতে চাই। একই সঙ্গে ক্ষুধা ও যুদ্ধের সঙ্গে লড়াই করতে চাই না’, বলেন আবু জাওয়াদ।