ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত

হাসপাতালে হত্যাযজ্ঞ, স্তম্ভিত বিশ্ব

ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেকে। সেখানেই মঙ্গলবার রাতে চালানো হয় ভয়াবহ হামলা। বালিশ হাতে কাঁদছেন স্বজন হারানো এক নারী। গতকাল মধ্য গাজার আল–আহলি আল–আরাবি হাসপাতাল চত্বরে
ছবি: এএফপি

‘আহত মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে অস্ত্রোপচারকক্ষের দিকে আসছিলেন আর চিৎকার করে বলছিলেন, “আমাদের সাহায্য করুন, আমাদের সাহায্য করুন।” তখন হাসপাতালের ভেতরে হতাহত মানুষের দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।’ বলছিলেন গাজার আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ফাদেল নাইম।

নাইম বলছিলেন, ‘মরদেহ, মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ আর আহত মানুষে হাসপাতাল ভরে গিয়েছিল।

আমরা যাকে পেরেছি, চিকিৎসা দিয়েছি। কিন্তু হতাহত মানুষের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে আমাদের অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আমাদের সামনে জীবন্ত অনেক মানুষকে মরতে দেখেছি।’

এভাবেই গত মঙ্গলবার রাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে গাজার আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালে হামলার পর ভয়ংকর সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী চিকিৎসক নাইম। হাসপাতালে ওই হামলায় ৪৭১ জন নিহত এবং ৩১৪ জন আহত হয়েছেন বলে গতকাল ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

২০০৭ সালে গাজায় হামাস নির্বাচিত হওয়ার পর ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের পাঁচ দফা যুদ্ধ হয়েছে; কিন্তু কখনো অবরুদ্ধ গাজার কোনো হাসপাতালে এতটা ভয়াবহ হামলা চালানো হয়নি। হাসপাতালে ভয়াবহ এই হামলা পুরো বিশ্বকে হতভম্ব করেছে। এর জেরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে।

আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক ইব্রাহিম আল-নাকা বলছিলেন, ‘ইসরায়েলি বোমা হামলা থেকে বাঁচতে যাঁরা, বিশেষ করে নারী-শিশুরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এই হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁরা এই স্থানকে নিরাপদ স্বর্গ ভেবেছিলেন। আমরা জানি না, কী ধরনের গোলা এখানে আঘাত হেনেছিল। তবে আমরা দেখেছি, এই গোলা যখন হাসপাতালে আঘাত হানে, তখন অসংখ্য শিশুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।’

আল-জাজিরায় সম্প্রচারিত ভিডিওতে দেখা গেছে, বহুতল হাসপাতাল ভবন থেকে গাঢ় ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। চারদিকে কেবল মানুষের আর্তনাদ। হাসপাতাল ও এর আশপাশে নারী-শিশুসহ মানুষের নিথর দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভবনের চারপাশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ফিলিস্তিন অভিযোগ করছে, ইসরায়েল হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আকাইলা বলেন, ইসরায়েলই হাসপাতালে ‘গণহত্যা’ চালিয়েছে।

হামাস বলছে, হাসপাতালে নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বাস্তুচ্যুত মানুষ।

কিন্তু ইসরায়েল অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো প্রথমে হামাস এবং পরে ফিলিস্তিন ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) যোদ্ধাদের এই হামলার জন্য দায়ী করেছে।

ইসরায়েল পরে একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করে বলেছে, হাসপাতালে হামলার এই ভিডিও ড্রোন দিয়ে ধারণা করা। এটা দেখিয়ে তারা দাবি করছে, ইসরায়েল এই হামলার জন্য দায়ী নয়। কারণ, হাসপাতাল ভবনে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র বা বোমা হামলার চিহ্ন নেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল বুধবার ইসরায়েল সফরে গিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর তাদের সুরেই কথা বলেছেন। তিনিও দাবি করছেন, ইসরায়েল নয়, তৃতীয় কোনো পক্ষ এই হামলা চালিয়েছে।

জো বাইডেনের এই সফরকালে মিসর থেকে গাজায় মানবিক ত্রাণসহায়তা নিয়ে যেতে বাধা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। আর গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের জন্য ১০ কোটি ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

বাইডেন যখন ইসরায়েলে, তখনো হামলা চলেছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন তেল আবিবে নামলেন, তখনো গাজায় অবিরাম ইসরায়েলি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চলছিল। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গতকাল বিকেল পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় ৩ হাজার ৪৭৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, গত ১২ দিনের হামলার তুলনায় মঙ্গলবার হাসপাতালে হামলা ছিল ভয়ংকর। এই হামলা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিল, প্রথমে ইসরায়েলিরা নিজেদের বাড়িতে হত্যার শিকার হয়েছেন। এরপর ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো নিজেদের বাড়ি ও হাসপাতালে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে।

জীবিতদের খোঁজে উদ্ধারকর্মীরা হাসপাতালে রক্তমাখা ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কুদরা বলেন, হাসপাতাল থেকে সর্বশেষ হিসাবমতে ৪৭১টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো উদ্ধারকাজ চলছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও মৃতদেহ রয়েছে।

ইসরায়েলি বোমায় গাজা যখন জ্বলছিল, আহত ও আতঙ্কিত মানুষের আর্তচিৎকারে যখন চারদিকে এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছিল, তখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে বাইডেন যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি গাজার হাসপাতালে “বিস্ফোরণের” ঘটনায় ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ।’ হামলায় অন্য কোনো পক্ষ জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনি ইসরায়েলি নয়, তাঁর নিরাপত্তা দলের দেওয়া তথ্য থেকে এ কথা বলছেন।

হতভম্ব বিশ্ব, নিন্দা

গাজার হাসপাতালে হামলার ঘটনা পুরো বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। তুরস্ক, জর্ডান, মিসর, ইরাক, ইরান, তিউনিসিয়া, লেবাননসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। ফিলিস্তিনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে।

হামলার নিন্দা জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি, জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ প্রমুখ।

এ ঘটনায় ইসরায়েলকে ‘যুদ্ধাপরাধের’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) প্রধান মুসা ফাকি মাহামাত। আরব লিগের প্রধান আহমেদ আবুল গেইত বলেছেন, পশ্চিমাদের অবশ্যই এই মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ বন্ধ করতে হবে।

আবারও ভেটো যুক্তরাষ্ট্রের

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল মানবিক অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব এনেছিল ব্রাজিল। তবে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে প্রস্তাবটি বাতিল হয়। এর বাইরে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত ছিল।

বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক বাতিল

হাসপাতালে হামলার জেরে ইসরায়েল সফররত বাইডেনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন আরব নেতারা। ইসরায়েল সফর শেষে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে যাওয়ার কথা ছিল বাইডেনের। সেখানে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের।