বাশার আল-আসাদ ও তাঁর স্ত্রী আসমা আসাদ
বাশার আল-আসাদ ও তাঁর স্ত্রী আসমা আসাদ

আসাদ ও তাঁর পরিবারের ভাগ্যে এখন কী ঘটবে

সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদ গত রোববার ক্ষমতাচ্যুত হন। সেদিন প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে তিনি পালিয়ে যান রাশিয়ায়। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের অবসান হয়েছে। সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটেছে আসাদ পরিবারের টানা ৫৩ বছরের শাসনের। ২০০০ সালে বাশার আল–আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তাঁর বাবা হাফিজ আল–আসাদ একটানা ২৯ বছর দেশ শাসন করেছিলেন।

এখন সিরিয়া বিদ্রোহী যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি গোষ্ঠী। যে ঝোড়োগতিতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে নামানো হয়েছে, সেই একই গতিতে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। দেশটিতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে।

পালিয়ে যাওয়া আসাদ এখন স্ত্রী–সন্তান নিয়ে রাশিয়ায় রয়েছেন। মস্কো জানিয়েছে, রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে তাঁদের। তবে আসাদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের চূড়ান্ত পরিণতি এখনো নিশ্চিত নয়। তাঁদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, সেটা এখনো কেউ জানেন না।

বাশার আল–আসাদকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করানোর সম্ভাবনা কার্যত নেই বললে চলে। কেননা, বাশার আল–আসাদের আপাতত রাশিয়া ছেড়ে এমন কোনো দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, যেখান থেকে তাঁকে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো হতে পারে কিংবা কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা হতে পারে।

আসাদ রাশিয়ায় কেন

বাশার আল–আসাদের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। বিশেষ করে ১৩ বছর আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে দামেস্ক–মস্কো সম্পর্ক আরও জোরদার হয়। সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।

সময়টা ২০১৫ সাল। আসাদের সমর্থনে সিরিয়ায় বিমান হামলা শুরু করে মস্কো। লক্ষ্যবস্তু সরকারবিরোধী বিদ্রোহীরা। যুদ্ধের মোড় আসাদের পক্ষে ঘুরিয়ে দিতে তাঁর সমর্থনে পূর্ণোদ্যমে হামলা চালায় রুশ বাহিনী।

লন্ডনভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংগঠন সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, সিরিয়ার ভূখণ্ডে রাশিয়ার বিমান হামলায় গত ৯ বছরে ২১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮ হাজার ৭০০ জনই বেসামরিক মানুষ।

বাশার আল–আসাদ ও ভ্লাদিমির পুতিন

গত নভেম্বরের শেষ দিক থেকে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার কয়েকটি শহরে একের পর এক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা ঝড়োগতিতে এগিয়ে আসতে থাকেন রাজধানী দামেস্কের দিকে। এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া কেন আগের মতো বাশার আল–আসাদের পাশে থাকল না, তাঁকে রক্ষা করল না—এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে করতে রাশিয়া হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল কিংবা আসাদকে সহায়তা করার জন্য মস্কো হয় আগ্রহী ছিল না, নয় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রুশ প্রশাসনের সক্ষমতা ছিল না।

বিদ্রোহী যোদ্ধারা রোববার যখন দামেস্কে ঢুকে পড়েন, তখন খবর পাওয়া যায়, বাশার আল–আসাদ পালিয়ে গেছেন। তবে তাঁর গন্তব্য সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই জানা যায়নি। কয়েক ঘণ্টা পর রুশ সরকার জানায়, আসাদ তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মস্কোয় আছেন। ‘মানবিক দৃষ্টিকোণ’ থেকে তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

এর পরদিন সোমবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের কাছে সাংবাদিকেরা আসাদের পালিয়ে আসা ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে পেসকভ বলেন, ‘অবশ্যই, এমন একটি সিদ্ধান্ত (রাজনৈতিক আশ্রয়) রাষ্ট্রপ্রধানকে না জানিয়ে সম্ভব নয়। এটা তাঁরই (পুতিনের) সিদ্ধান্ত।’

মস্কোর সঙ্গে আসাদের ঘনিষ্ঠতার কথা বিভিন্ন নথিতে উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, মস্কোয় আসাদের স্বজনদের অন্তত ১৮টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। এমনকি শুধু গৃহযুদ্ধের সময়ই কোটি কোটি ডলার সিরিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

আসাদের বড় ছেলে হাফিজের বয়স ২২ বছর। মস্কোয় পিএইচডি করছেন তিনি। বিশৃঙ্খলার সপ্তাহান্তে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এক প্রতিবেদনে জানায়, সিরিয়ায় রুশ সামরিক ঘাঁটি আর কূটনৈতিক মিশনগুলো রক্ষায় দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করছে মস্কো।

বাশারের স্ত্রী–সন্তানেরা

বাশার আল–আসাদের স্ত্রীর নাম আসমা আসাদ। তিনি যুক্তরাজ্য ও সিরিয়ার যৌথ নাগরিক। পশ্চিম লন্ডনে একটি সিরীয় পরিবারে আসমার জন্ম এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা।

আসমা পেশায় বিনিয়োগ ব্যাংকার ছিলেন। এর আগে লন্ডনে পড়াশোনা করেন। ২০০০ সালে পাকাপাকিভাবে সিরিয়ায় চলে আসেন আসমা। বিয়ে করেন বাশার আল–আসাদকে। ওই বছরই বাবা হাফিজ আল–আসাদের মৃত্যুতে বাশার আল–আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের (এলএসই) ভিজিটিং ফেলো নাসরিন আলরেফাই বিবিসিকে বলেন, আসমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট রয়েছে। কাজেই রাশিয়ায় থাকার পরিবর্তে তিনি চাইলে যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারেন।

তবে নাসরিনের মতে, বাশারপত্নী আসমা হয়তো রাশিয়াতেই থেকে যেতে পারেন। কেননা, আসমার বাবা ফাওয়াজ আল–আখরাস নিজেও এখন রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, আসমার বাবা ফাওয়াজ আল–আখরাস পেশায় চিকিৎসক। মা সাহার একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। মেয়ে আর মেয়ের পরিবারের পাশে থাকতে তাঁরা মস্কোয় থাকতে আগ্রহী।

বাশার আল–আসাদ ও আসমার সংসারে তিন সন্তান—হাফিজ, জেইন ও করিম।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, আসাদ পরিবারের সদস্যদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি থেকে ২০০ কোটি ডলারের মধ্যে। তবে তাঁদের প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ নিশ্চিত করে অনুমান করা সম্ভব নয়। ধারণা করা হয়, আসাদ পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে, আবাসন খাতে কিংবা অফশোর কর স্বর্গে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা হয়েছে।

২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেছিলেন, স্বামী বাশার আল–আসাদ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়তায় ফার্স্ট লেডি আসমা সিরিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত ‘যুদ্ধের মুনাফাখোরদের’ একজন হয়ে উঠেছিলেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরিয়ার প্রধানতম ‘অর্থনৈতিক খেলোয়াড়দের’ সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার সম্পর্ক’ বজায় রেখে চলতেন আসাদ ও আসমা। ওই ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করতেন এ দম্পতি। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করত।

সিরিয়ায় পতন ঘটেছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের দুই যুগের শাসনের

প্রতিবেদনের তথ্য, সিরিয়ার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গঠিত অর্থনৈতিক কমিটিতে প্রভাব রাখতেন ফার্স্ট লেডি আসমা। এমনকি দেশের খাদ্য আর জ্বালানি খাতের ভর্তুকি, বাণিজ্য ও মুদ্রার বিষয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতেন।

২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেছিলেন, স্বামী বাশার আল–আসাদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় ফার্স্ট লেডি আসমা সিরিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত ‘যুদ্ধের মুনাফাখোরদের’ একজন হয়ে উঠেছিলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাশারপত্নী আসমাকে তাঁর ‘পরিবারের ব্যবসায়িক প্রধান’ ও ছোটখাটো একজন ‘শাসক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর মতে, বাশার আল–আসাদের ভাই রামি মাখলৌফের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন আসমা। রামি সিরিয়ার শীর্ষ ধনীদের একজন।

বিচার হবে কি

সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেন, সিরিয়ার মানুষ ভয়ানক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অবর্ণনীয় মানবিক দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা, ব্যারেল বোমার আঘাত, বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের ঘটনার পাশাপাশি হত্যা, নির্যাতন, গুম, নির্মূলের উদ্দেশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছেন তাঁরা।

বাশার আল–আসাদের শাসনামলের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব।

এদিকে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নেতা আবু মোহাম্মদ আল–জুলানি গত মঙ্গলবার বলেছেন, বাশার আল–আসাদের ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রাজনৈতিক বন্দীদের নির্যাতনে জড়িত থাকলে তাঁকে শনাক্ত করে পরিচয় প্রকাশ করা হবে। সেই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের যেসব ব্যক্তি বিদেশে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে অন্তর্বর্তী সরকার।

এরই মধ্যে আসাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির দাবি তুলেছেন ফ্রান্সের অনুসন্ধানী বিচারকেরা। তাঁদের অভিযোগ, সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত এ নেতা নিজ দেশের মানুষের ওপর যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছেন।

সন্দেহজনক অপরাধের জন্য আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে রাশিয়া তার নিজ দেশের নাগরিকদের অন্য দেশ বা রাজ্যে প্রত্যর্পণ করে না। কাজেই আসাদকে সিরিয়ায় ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সম্ভাবনা কার্যত নেই বললেই চলে। কেননা, আসাদের আপাতত রাশিয়া ছেড়ে এমন কোনো দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, যেখান থেকে তাঁকে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানো হতে পারে কিংবা কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা হতে পারে।