ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের আল-মাগাজি শরণার্থীশিবির। এই শিবিরে গত শনিবার গভীর রাতে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় অন্তত ৪৭ জন নিহত হয়। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
এই শিবিরেরই বাসিন্দা ৫৩ বছর বয়সী সাঈদ আল-নেজমা। ভয়াবহ এই হামলার ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সাঈদ বলেন, তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পান তিনি।
শিবিরটিতে ইসরায়েলি হামলার পরের ঘটনা সম্পর্কে সাঈদ বলেন, ‘আমিসহ অন্যরা মিলে সারা রাত ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ বের করার চেষ্টা করি। আমরা ধ্বংসস্তূপে শিশুদের লাশ পাই। লাশগুলো ছিল ছিন্নভিন্ন।’
একই শিবিরের বাসিন্দা আরাফাত আবু মাশাইয়া। তিনি বলেন, ইসরায়েলি বিমান হামলায় শিবিরের বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
গতকাল রোববার সকালের দিকে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আরাফাত বলেন, ‘এটি একটি সত্যিকারের গণহত্যা।’
আরাফাত আরও বলেন, ‘এখানে সবাই শান্তিপ্রিয় মানুষ। যে বা যাঁরা বলেন, এখানে প্রতিরোধ যোদ্ধা আছেন, আমি তাঁদের চ্যালেঞ্জ জানাই।’
প্রায় এক মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। এই হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৭০। নিহত মানুষের মধ্যে অন্তত ৪ হাজার ৮টি শিশু রয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব তথ্য জানিয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার তিনটি শরণার্থীশিবিরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এগুলোর মধ্যে আল-মাগাজি শরণার্থীশিবির রয়েছে।
গাজার অন্যান্য অংশ থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া অনেক ফিলিস্তিনি আল-মাগাজি শরণার্থীশিবির আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এখানে আশ্রয় নিয়েও তাঁরা হামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
গাজার উত্তরাঞ্চলে সামরিক অভিযান জোরদার করেছে ইসরায়েল। এ জন্য তারা গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরে যেতে বলেছিল।
গতকালও ইসরায়েলি উড়োজাহাজ থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলে লিফলেট ফেলা হয়। এতে তারা বেসামরিক লোকজনকে দ্রুত গাজার দক্ষিণে যাওয়ার আহ্বান জানায়।
ইসরায়েলি বাহিনীর সবশেষ এই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে গাজা উপত্যকার প্রধান উত্তর-দক্ষিণ মহাসড়কে বেসামরিক লোকজনকে ছুটতে দেখা যায়। অনেকেই পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁদের হাতে-কাঁধে ছিল বহন করার মতো জরুরি জিনিসপত্র।
বাস্তুচ্যুত এক ফিলিস্তিন বলেন, ইসরায়েলি সেনাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে দুই হাত ওপরের দিকে তুলে রাখতে হয়েছিল। এভাবে তিনি অন্তত ৫০০ মিটার এলাকা হেঁটে এসেছেন।
অপর এক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি সড়কের পাশে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িতে মানুষের লাশ দেখার কথা জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘শিশুরা প্রথমবারের মতো ট্যাংক দেখেছে। হে বিশ্ব, আমাদের প্রতি দয়া করো।’
গাজার আল-আকসা হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, গতকাল বিকেলে মধ্য গাজার বুরেজি শরণার্থীশিবিরের একটি স্কুলের কাছে ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় কয়েকটি বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে কমপক্ষে ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
বুরেজি শরণার্থীশিবিরটি প্রায় ৪৬ হাজার মানুষের আবাসস্থল। গত বৃহস্পতিবারও এই শিবিরটি ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল।
আল-জাজিরার যাচাই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরায়েলি বিমান হামলার পর শিবিরের ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার-অনুসন্ধান তৎপরতা চালাচ্ছেন লোকজন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলার নিশানা হওয়া গাজার তৃতীয় শরণার্থীশিবিরটির নাম জাবালিয়া। তিন শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলায় অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
আল–জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের কাছ থেকে প্রতিবেদন করছিলেন। তিনি বলেন, গাজার শরণার্থীশিবিরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনী একটি ‘পদ্ধতিগত হামলা’ চালাচ্ছে বলে মনে হয়।
হানি মাহমুদ বলেন, মধ্য ও দক্ষিণ গাজার শরণার্থীশিবিরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনী বারবার বিমান হামলা চালাচ্ছে। এ কারণে নিরাপত্তার কথা বলে গাজার দক্ষিণে যাওয়ার বিষয়ে ইসরায়েলের নির্দেশনাকে বেসামরিক লোকজন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে ১৫ লাখ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গতকাল অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। বৈঠকে গাজায় অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান আব্বাস।
বৈঠকে বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষা দিতে, বিদেশিদের চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে গাজায় ‘মানবিক বিরতির’ পক্ষে ওয়াশিংটনের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন ব্লিঙ্কেন। তবে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। বরং হামাসকে নির্মূলের যে লক্ষ্যের কথা ইসরায়েল বলে আসছে, তার পক্ষে তিনি মত দেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবার গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি গতকাল দক্ষিণ ইসরায়েলের একটি বিমানঘাঁটিতে যান। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের জিম্মিদের ফিরিয়ে না দিলে কোনো যুদ্ধবিরতি হবে না। আমরা আমাদের শত্রু ও বন্ধু উভয়কেই এ কথা বলি। আমরা তাদের (হামাস) পরাজিত না করা পর্যন্ত (হামলা) চালিয়ে যাব।’
ইসরায়েলের দাবি, তারা গাজায় হামাসের যোদ্ধা, হামাসের স্থাপনাকে নিশানা করেই হামলা চালাচ্ছে। বেসামরিক লোকজনকে হামাস মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ ইসরায়েলের।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। হামলায় ইসরায়েলের ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি ব্যক্তি নিহত হন। এ ছাড়া দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ইসরায়েল থেকে ধরে গাজায় নিয়ে জিম্মি করে রেখেছে হামাস। সেদিন থেকেই ফিলিস্তিনের গাজাকে অবরুদ্ধ করে নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
গাজায় স্থল অভিযানও চালাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের হামলায় গাজায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। যুদ্ধবিরতির প্রশ্নে ইসরায়েলের সুরেই কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র।