ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বাড়ছে 

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় বাইডেনের নিঃশর্ত সমর্থনের বিরুদ্ধে দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হচ্ছে। খোদ মার্কিন প্রশাসনের ভেতর থেকে তাঁর ইসরায়েল নীতির বিরোধিতা শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরসহ ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি দিয়েছেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। গত মঙ্গলবার

ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার নামে এক মাস আগে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল ইসরায়েল, এখন তা জাতিনিধনে দাঁড়িয়েছে। নিহতের সংখ্যা ১১ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রতি ১০ মিনিটে একটি শিশু নিহত হচ্ছে। প্রতি তিনজন নিহতের একজন হয় শিশু অথবা নারী। 

একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূলের লক্ষ্যে পরিচালিত যুদ্ধের নামে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে বিশ্বের অধিকাংশ রাজধানীতে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসের সামনে কয়েক লাখ মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, অবিলম্বে এই জাতি হত্যা বন্ধ করতে হবে।

অনেকেই বলছেন, প্রতিবাদের তীব্রতা সত্তর দশকে ভিয়েতনামবিরোধী বিক্ষোভের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতিবাদ বিক্ষোভে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষও যোগ দিয়েছিলেন।

এবারের প্রতিবাদের একটি লক্ষণীয় ব্যতিক্রমী বিষয় হচ্ছে, শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীরাই নন, সমাজের নানা অংশের মানুষ এসব কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনে চাকরি নিয়েছেন এমন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র দপ্তরের সদস্য, এমনকি মার্কিন কংগ্রেসে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরাও রয়েছেন। 

গত সপ্তাহে ক্যাপিটল হলের সিঁড়িতে শতাধিক কংগ্রেস কর্মী এক নাটকীয় প্রতিবাদে মিলিত হন। তাঁদের বক্তব্য, কংগ্রেস সদস্যরা যেসব এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, সেখানকার মানুষ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি করছেন। কিন্তু কংগ্রেস সদস্যরা জনগণের সে কথায় কান দিচ্ছেন না। একটি খোলাচিঠি হিসেবে বিলি করা এই প্রতিবাদপত্রে একাধিক ইহুদি কর্মকর্তাও স্বাক্ষর করেছেন। 

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের প্রায় ৭০ জন মুসলিম ও আরব কর্মকর্তাও মার্কিন নীতির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘আমরা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম এই বিশ্বাস থেকে যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা রক্ষা করা হবে।’ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব কর্মকর্তা গাজায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি তুলেছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

সম্ভবত সবচেয়ে নাটকীয় প্রতিবাদ এসেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মী ও কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। অন্তত ৫০০ কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত প্রতিবাদবার্তায় ঢালাওভাবে বাইডেন প্রশাসন যেভাবে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে, তার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একটি নয়, তিনটি প্রতিবাদপত্র মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধ শুরুর পরপরই প্রথম প্রতিবাদপত্রটি পররাষ্ট্র দপ্তরে এসে পৌঁছায়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই চিঠির কথা প্রকাশ করা হয়নি। কয়েক দিন আগে ব্লিঙ্কেন নিজে এক চিঠিতে পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মীদের পাঠানো প্রতিবাদপত্রের কথা স্বীকার করার পর ব্যাপারটা জানাজানি হয়। সেই চিঠিতে ব্লিঙ্কেন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মীদের আশ্বাস দিয়ে লেখেন, তাঁদের উদ্বেগের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। মার্কিন নীতি প্রণয়নে তাঁদের মতামতকে উপেক্ষা করা হবে না।

এ রকম এক বা একাধিক প্রতিবাদপত্র মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন—সে কথা প্রথম জানায় ওয়েব-পত্রিকা পলিটিকো। এমন একটি গোপন চিঠি তাদের হাতে রয়েছে জানিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, এই চিঠির ভাষা ও বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, পররাষ্ট্র দপ্তরের অনেক কর্মীর মনেই ইসরায়েল ও গাজা যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের চলতি নীতির প্রতি তাঁদের আস্থা নেই।

পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মীদের এই মনোভাব যদি অব্যাহত থাকে এবং তা আরও কঠোর রূপ ধারণ করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সমন্বিত নীতি গ্রহণ বাইডেন প্রশাসনের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

পত্রিকাটি তাদের হাতে আসা প্রতিবাদপত্র থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এতে বাইডেন প্রশাসনকে মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য প্রকাশ্যে ইসরায়েলের চলতি কার্যকলাপের সমালোচনা করার দাবি এসেছে। পলিটিকোর হাতে আসা ওই প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ‘আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা অনুসরণে ইসরায়েলের ব্যর্থতার, বিশেষ করে আইনসম্মত সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা সীমিত রাখতে না পারার প্রকাশ্য সমালোচনা করতে হবে।

ইসরায়েল যখন অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার প্রতি সমর্থন দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে, তখন আমাদের এ কথা জানাতে হবে যে ইসরায়েল যা করছে, তা আমাদের মূল্যবোধের পরিপন্থী। ইসরায়েল যাতে একতরফা ও বিনা বাধায় যা খুশি তা করতে না পারে, সে জন্য এই প্রকাশ্য প্রতিবাদ প্রয়োজন।’

ডিসেন্ট চ্যানেলে প্রতিবাদপত্র

পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতিবাদপত্রটি এসেছে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘ডিসেন্ট চ্যানেল’–এর মাধ্যমে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দিতে ১৯৭১ সালে এই চ্যানেল বা ভিন্নমত প্রকাশের মাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর সেখানে কর্মরত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ও তাঁর সহকর্মীরা মার্কিন নীতির প্রতিবাদ করে এই চ্যানেলের মাধ্যমেই তাঁদের ভিন্নমত প্রকাশ করেন।

পররাষ্ট্র দপ্তরের ভাষ্য অনুসারে, ডিসেন্ট চ্যানেলের মাধ্যমে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি ও তথ্য প্রকাশের সুযোগ পান। এর মাধ্যমে ফলে নতুন ভাবনাচিন্তার প্রকাশ হয়, পুরোনো ভাবনাচিন্তা বদলে অধিক অর্থপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন সম্ভব হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের উদার এই উদ্যোগ সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন কোন প্রশ্নে ভিন্নমত প্রকাশিত হয়, প্রায়ই তা সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। গাজা প্রশ্নে প্রায় ৫০০ কর্মকর্তা ভিন্নমত প্রকাশ করে যে তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমে তা ফাঁস না হলে হয়তো বাক্সবন্দী হয়েই থাকত এটি।

ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার নিঃশর্ত সমর্থন কতটা ক্ষতের সৃষ্টি করেছে, তার আরেক প্রমাণ হচ্ছে পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যম পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জশ পলের পদত্যাগ। ১১ বছর তিনি এই মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যুরোতে কাজ করেছেন। কেন পদত্যাগ করছেন তার ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা ছিল গভীরভাবে নিন্দনীয়।

কিন্তু এ কথাও বলতে হবে, এই হামলার জবাবে মার্কিন সমর্থনে ইসরায়েল গাজায় যে সামরিক অভিযান শুরু করেছে, তা উভয় পক্ষের নিরীহ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার যে অন্ধ সমর্থন, তা শুধু শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রতিকূলই নয়, ভয়ানক ক্ষতিকরও বটে।  ইসরায়লের প্রতি এই মার্কিন নীতি রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী ও বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কিছু নয়।

অন্য আরেক কর্মচারী সিলভিয়া ইয়াকুব নিজের নাম ব্যবহার করে এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে খোলামেলাভাবেই ইসরায়েলকে ‘জেনোসাইড’ বা জাতিনিধনে মদদ দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে অভিযুক্ত করেছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে তিনি বাস্তবতা থেকে বিযুক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। 

অনড় বাইডেন

বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষোভ অথবা অভ্যন্তরীণ মতভেদের কারণে ইসরায়েল প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে আছে বলে মনে হয় না। মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি অর্থ ও লবির প্রভাব অপরিসীম।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজে রাজনৈতিক জীবনের গোড়া থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের কট্টর সমর্থক। ১৯৮৬ সালে সিনেট ফ্লোরে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইসরায়েল না থাকলে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই ইসরায়েলকে “আবিষ্কার” করতে হতো।’ 

ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁদের উদ্দেশে বাইডেন বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। আমরা প্রতিবছর ইসরায়েলকে যে তিন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে থাকি, তা আমাদের সবচেয়ে অর্থপূর্ণ বিনিয়োগ।’ 

যুক্তরাষ্ট্রের এই ইসরায়েলপ্রীতি অবশ্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ-অপছন্দে নির্ধারিত নয়। এর পেছনে রয়েছে আমেরিকার নিজস্ব কৌশলগত সমীকরণ। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার নীতি বদলায় না। কারণ, দুই দেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অভিন্নতা। ইসরায়েল হলো মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নিজস্ব চাবুক। তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করার মতো একটি সামরিক ঘাঁটিও বটে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেকোনো মূল্যে সোভিয়েত কমিউনিজমকে ঠেকানো। মিসর ও ইরানের মতো দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়ার নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সোভিয়েত কমিউনিজমকে ঠেকানো আরও জরুরি হয়ে পড়ে।

আর এই কাজে প্রয়োজনে সামরিক শক্তির ব্যবহার ছাড়াও অঞ্চলের আরব দেশগুলোর ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য আমেরিকার অপরিহার্য একটি হাতিয়ার হচ্ছে ইসরায়েল। ঠিক সেই কারণে ইসরায়েলকে সামরিকভাবে সুসজ্জিত করতে ১৯৪৮ থেকে এ পর্যন্ত দেশটিকে আমেরিকা ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সাহায্য দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী ও সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েল এখনো প্রতিবছর সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি মার্কিন সামরিক সাহায্য পেয়ে থাকে। 

ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই ছাতা-ধরা নীতির প্রতিবাদ দেশের ভেতরে–বাইরে বাড়ছে। জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে আমেরিকার মানুষের রাজনৈতিক আনুগত্যে পরিবর্তন আসছে।

শুধু আরব ও মুসলিম নাগরিক নয়, নতুন প্রজন্মের ইহুদিদের মধ্যেও পুরোনো অবস্থান পরিবর্তনের স্পষ্ট লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রশাসন যদি এই পরিবর্তনের রাজনৈতিক গুরুত্ব অগ্রাহ্য করে, তাহলে আখেরে তাদেরই পস্তাতে হবে।