যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টির নেতা বেনি গানৎস। যুদ্ধ–পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, এ নিয়ে নিজের একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁর দেওয়া সেই প্রস্তাবে একমত হতে পারেননি। এ কারণে পদত্যাগ করেছেন তিনি।
গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে ছয় দফা এ পরিকল্পনা যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার কাছে তুলে ধরেন বেনি গানৎস। তখনই তিনি বলেছিলেন, মন্ত্রিসভা তাঁর এ প্রস্তাবে একমত না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলা হয়ে থাকে বেনি গানৎসকে। তিনি নেতানিয়াহুর তুলনায় কিছুটা মধ্যপন্থী বলে মনে করা হয়। গানৎস কেন পদত্যাগ করলেন এবং তাঁর পদত্যাগ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের জন্য কী অর্থ বহন করে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
গানৎস বলেছেন, তিনি যে ছয় দফা পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন, তাতে ছিল—যুদ্ধ–পরবর্তী গাজার শাসনব্যবস্থা হবে এমন, যেখানে বেসামরিক প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আরব দেশ ও ফিলিস্তিনের যৌথ অংশগ্রহণ থাকবে। আর উপত্যকাটির নিরাপত্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের হাতে।
গানৎসের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব সমানভাবে সব ইসরায়েলিকে নিতে হবে। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের ক্ষেত্রে কট্টরপন্থী ইহুদিদের যুক্ত করতে হবে। নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের কারণে এসব ইহুদিকে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হয় না।
দেশে-বিদেশে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, ব্যক্তিগত স্বার্থ্যের কারণে গানৎসের এ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন নেতানিয়াহু। পদত্যাগপত্রে বেনি গানৎসও লিখেছিলেন, ‘নেতানিয়াহু আমাদের সত্যিকার বিজয়ের দিকে অগ্রসর হতে দিচ্ছেন না।’
ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল মঙ্গলবার টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছেন, নেতানিয়াহু যে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বাঁচানোর জন্যই এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছেন, সেটা বিশ্বাস করার সব ধরনের কারণ রয়েছে।
ঘুষ নেওয়া, প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের মতো একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন নেতানিয়াহু। এ নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে চাপে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে, এই যুদ্ধ এসব আইনি জটিলতা থেকে নেতানিয়াহুর রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই তিনি এ যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে চাচ্ছেন না।
এ ছাড়া এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে, গাজা নিয়ে যেকোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে ফাটলের শঙ্কা। কারণ, জোট সরকারের কেউ গাজায় অবৈধ বসতি স্থাপন করার পক্ষে। আবার গানৎসের মতো কেউ কেউ আন্তর্জাতিক একটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে গাজার শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে চান।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগও আছে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে। অথচ ইসরায়েলের নিরাপত্তা তিনিই সবচেয়ে ভালো দিতে পারেন, এমন প্রচারণা চালিয়ে এসেছেন নেতানিয়াহু। অনেকের মতে, এই ব্যর্থতার দায় ঢাকতেও নেতানিয়াহু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছেন।
বেনি গানৎসের পদত্যাগ নেতানিয়াহুর মতো কট্টর ডানপন্থীদের জন্য ‘সাপে বর’ হয়ে এসেছে। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা তিন সদস্যের। গানৎস পদত্যাগ করায় এই মন্ত্রিসভায় এখন আছেন দুজন। একজন নেতানিয়াহু, অন্যজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। গানৎসের পদত্যাগের কারণে তাঁর জায়গায় যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় নেতানিয়াহু এমন একজন কট্টর ডানপন্থীকে নিতে পারেন, যিনি থাকলে সরকার পরিচালনা তাঁর জন্য সহজ হবে।
জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গাভির ইতিমধ্যে গানৎসের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। বেন গাভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোরিচের মতো কট্টর ডানপন্থীদের মধ্যে ঐক্য খুবই ভালো। দুজনই নেতানিয়াহুর জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় আছেন। পার্লামেন্টে তাঁদের দুজনের দলের আসনসংখ্যা গানৎসের মধ্যপন্থী দলের চেয়ে বেশি।
গানৎস না থাকায় ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীদের সবচেয়ে বড় সমালোচক আর থাকছেন না। এতে সরকার পরিচালনায় কট্টর ডানপন্থীরা আরও বেশি সুবিধা পাবেন।
গানৎসের পদত্যাগ গাজার জন্য তেমন ভালো কিছু বয়ে আনবে না। বেন গাভির ও স্মোরিচের যে পরিকল্পনা, তাতে গাজার ফিলিস্তিনিদের ‘স্বেচ্ছায় অন্যত্র গিয়ে বসবাসের’ কথা যেমন আছে, তেমনি গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনও রয়েছে।
গাভির ও স্মোরিচের এই পরিকল্পনার সঙ্গে নেতানিয়াহু হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে কোনো বিরোধে যেতে দেখা যায়নি তাঁকে।
রাজনীতিতে যদি ফাটলও দেখা যায়, তাতেও বেশির ভাগ ইসরায়েলি যুদ্ধের পক্ষে থাকবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু হামাসকে নির্মূল করার যে লক্ষ্যের কথা নেতানিয়াহু বলছেন, তা অর্জন করা সম্ভব—এমনটা খুব কম ইসরায়েলি মনে করেন। এ ছাড়া সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের মুক্ত করা যাবে—এতেও আস্থা নেই বেশির ভাগ ইসরায়েলির।
তেল আবিবের কথিত গণতন্ত্র চত্বরসহ আরও বিভিন্ন স্থানে প্রতি সপ্তাহে হাজারো ইসরায়েলি জড়ো হয়ে বন্দীদের মুক্ত করে আনতে চুক্তি করার দাবি জানাচ্ছেন। একই সঙ্গে নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের দাবিও জানাচ্ছেন এই বিক্ষোভকারীরা।
বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুকে ধারাবাহিকভাবে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন গানৎস। শুধু গানৎস পদত্যাগের হুমকি দেওয়ার সময় তাঁর চেয়ে নেতানিয়াহু কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। এ কারণে ইসরায়েলিরা মনে করছেন, গানৎসের পদত্যাগের হুমকির অর্থ হচ্ছে, তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে।
তবে চিন্তন প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ইয়েল লরি পারেদেসের মতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলেও নির্বাচন এখন হবে না। তাঁর মতে, নেতানিয়াহু যদি আগামী গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত জোট সরকার টিকিয়ে রাখতে পারেন, তাহলে আইন অনুযায়ী আগামী মার্চের আগে নির্বাচন হবে না।