হলিউডের আলোচিত সিনেমা ‘বার্বি’ নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে রক্ষণশীল উপসাগরীয় অঞ্চল। কুয়েত ও লেবাননে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ছবিটির প্রদর্শনী। তবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের হলে চলছে সিনেমাটি। দেশ দুটির নারীরা বার্বির রঙে নিজেদের রাঙিয়ে হাজির হচ্ছেন সিনেমা হলে। গোলাপি রঙের বোরকা পরে নারীরা ‘বার্বি’র পোস্টার-ফেস্টুনের সামনে ছবি তুলছেন।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমাজব্যবস্থা রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত। দেশ দুটিতে ২০১৮ সালের আগপর্যন্ত নারীদের গাড়ি চালানো কিংবা সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল না। অথচ সেই সমাজে রীতিমত ঝড় তুলেছে ‘বার্বি’। হলে ‘বার্বি’র পোস্টার-ফেস্টুনের সামনে গোলাপি বোরকা পরা নারীদের ভিড়ই এর প্রমাণ দিচ্ছে।
সিনেমা হলগুলোর সামনে বার্বি পুতুলের সেলফি বক্স স্থাপন করা হয়েছে। দর্শনার্থীরা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, ছবি বা সেলফি তুলছেন। রক্ষণশীল সমাজে নারীদের এমন পরিবর্তনে খুশি নন অনেকেই। যদিও এসব দেশে নারী অধিকার নিয়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।
এর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। ছবিতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ গোলাপি রঙের পোশাক পরা ছিলেন। পরে জানা যায়, ছবিটি ভুয়া। বাহরাইনের একজন ধর্মীয় নেতা ‘বার্বি’ সিনেমার ‘প্রগতিশীল’ অংশের বিরোধিতা করে আলোচনায় এসেছেন।
কুয়েত, লেবানন ও আলজেরিয়া নিষিদ্ধ করলেও সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি বাহরাইনেও ‘বার্বি’র প্রদর্শনী চলছে। ওমান ও কাতারে এই সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়নি। কুয়েতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, জননৈতিকতা ও সামাজিক ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে ‘বার্বি’ সিনেমাটি সে দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ‘বার্বি’ সিনেমার বিরুদ্ধে ‘সমকামিতা’ প্রচারের অভিযোগ এনেছেন লেবাননের সংস্কৃতিমন্ত্রী।
ওয়াদিমা আল-আমিরির বয়স ১৮ বছর। সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিক তিনি। থাকেন দুবাইয়ে। ওয়াদিমা বলেন, ‘আমি কখনোই কল্পনা করিনি, “বার্বি”র মতো একটি সিনেমা উপসাগরীয় দেশগুলোয় দেখানো হবে।’
৩০ বছর বয়সী সৌদি নাগরিক মাউনিরা দুবাইয়ে ‘বার্বি’ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তিন মেয়ে। সবাই বার্বির আদলে গোলাপি রঙের পোশাক পরেছিলেন। মাউনিরা বলেন, ‘যদি আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু দেখানো হয়, তাহলে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অঞ্চলে “বার্বি” নিষিদ্ধ করা উচিত। তবে আমরা সিনেমাটিকে একটি সুযোগ দিতে এসেছি।’
‘বার্বি’ উন্মাদনায় মেতেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দুবাইয়ের বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ খলিফার পাশে একটি বিশালাকার ডিজিটাল পর্দায় ‘বার্বি’র প্রচারণামূলক ভিডিও দেখানো হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ সামাজিকমাধ্যমে সেই ভিডিও শেয়ার করেছেন।
সৌদি আরবে ‘বার্বি’ সিনেমাটি বেশ শোরগোল ফেলেছে। দেশটিতে নারীদের জন্য কঠোর পর্দা প্রথা রয়েছে। পর্দা না করে সামাজিকমাধ্যমে ছবি আপলোড দিলে দেশটির নারীদের শাস্তি পেতে হয়। এমনকি সমকামিতা রক্ষণশীল সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় নিষিদ্ধ।
এমন রক্ষণশীল সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের রেঁস্তোরায় ‘বার্বি’ থেকে উৎসাহিত হয়ে বানানো খাবার ও পানীয় বিক্রি করা হচ্ছে। এমন উন্মাদনার পরও খুশি নন অনেকে।
হানান আল-মাউদির বাড়ি সৌদি আরবে। এই নারী চার সন্তানের জননী। দুবাইয়ের একটি সিনেমা হলে ভিন্ন একটি সিনেমা দেখতে পরিবার নিয়ে এসেছিলেন হানান। নেকাব ও হিজার পরা ছিলেন হানান। তিনি বলেন, ‘“বার্বি” দেখা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি স্বাধীনতা ও উন্মুক্ততাকে সমর্থন করি। কিন্তু “বার্বি” সিনেমায় পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে বলে শুনেছি। একজন পুরুষ মেকাপ করছে, নারীদের মতো পোশাক পরছে, ব্যবহার করছে—এসব মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
বাহরাইনে ‘বার্বি’ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন ধর্মীয় নেতা হাসান আল-হুসেইনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর লাখ লাখ অনুসারী রয়েছেন। ইনস্টাগ্রাম পোস্টে তিনি অভিযোগ করেন, বিয়ে ও মাতৃত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে রীতিমত বিদ্রোহ করেছে ‘বার্বি’। সেই সঙ্গে এ সিনেমায় পুরুষকে ‘পুরুষত্বহীন ও দানব’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
কুয়েতেও অনেকটা একই মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির সরকার জননৈতিকতা ও সামাজিক ঐতিহ্যপরিপন্থী বলে ‘বার্বি’ নিষিদ্ধ করেছে। তবে অনেক কুয়েতি পাইরেটেড প্রিন্টে বা গাড়ি চালিয়ে প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরবে গিয়ে ‘বার্বি’ দেখেছেন।
এর আগে চলতি মাসে একমাত্র উপসাগরীয় দেশ হিসেবে ‘টক টু মি’ সিনেমাটি নিষিদ্ধ করেছে কুয়েত। অস্ট্রেলিয়ার এ সিনেমার বিরুদ্ধে সমকামিতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
শেইখা আল-বাহাওয়েদ পেশায় সাংবাদিক। কুয়েতি এই নারী বলেন, ‘বার্বি’ এমন একটি সিনেমা, যেখানে শ্বেতাঙ্গ ও ঔপনিবেশিক মনোভাবের প্রকাশ দেখা যায়। খুবই অগভীর নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। শেইখা আরও বলেন, নারীবাদ কখনোই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎখাতের কথা বলে না। বরং এটা সমতা, ন্যায়বিচার ও সমান সুযোগের কথা বলে।