সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলে হাতে আটক হওয়া পুরুষদের কাপড়চোপড় খুলে নেওয়া ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেকেই ইসরায়েলের সমালোচনায় মুখর হন। যদিও ফিলিস্তিনিদের অপদস্থ করে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া ইসরায়েলের জন্য নতুন ঘটনা নয়। বিষয়টি নিয়ে গত ১০ ডিসেম্বর আল-জাজিরায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন হামাদ বিন খলিফা ইউনিভার্সিটির মিডল ইস্ট স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক ওয়েন জোনস।
কিছুদিন ধরেই কাপড়চোপড় খুলে নেওয়া ফিলিস্তিনি পুরুষদের অনেক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের মধ্যে বালক ও কিশোরও রয়েছে। তাঁদের কোথাও লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা গেছে। বন্দী এই ফিলিস্তিনিদের ট্রাকে করে ইসরায়েলি সেনারা নিয়ে যাচ্ছেন, এমন চিত্রও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে।
ইসরায়েল দাবি করেছে, এসব বন্দী সন্দেহভাজন হামাস যোদ্ধা। উত্তর গাজা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকি ইসরায়েলি বাহিনী কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, শুধু অন্তর্বাস পরা একজন ফিলিস্তিনি পুরুষ সারি থেকে আলাদা হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এবং সড়কের পাশে একটি বন্দুক রাখছেন। কিশোরেরা পরিচয়পত্র দেখাচ্ছে। এর মাধ্যমে এসব বন্দী যে ‘জঙ্গি’, তা ‘প্রমাণ’ করতে চায় ইসরায়েল।
কিন্তু ভিডিওটি খুব ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায়, এটা ছিল সাজানো। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে একজন সশস্ত্র যোদ্ধাকে দেখতে পারার পর মানুষের কাপড়চোপড় খুলে সারিতে দাঁড় করার সময় দেবে। তারপর ধীরেসুস্থে ভিডিও করার জন্য প্রস্তুত হবে। আর এই যোদ্ধাকে লাউডস্পিকারের মাধ্যমে তাঁর অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেবে এবং তাঁকে ‘হাবিবি’ (আরবিতে আমার প্রিয়) বলে সম্বোধন করবে।
পরে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তর গাজায় বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হওয়া জাতিসংঘ পরিচালিত একটি বিদ্যালয় থেকে ফিলিস্তিনি বালক, কিশোর ও পুরুষদের জোরপূর্বক তাঁদের পরিবার থেকে আলাদা করে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। তাঁদের মধ্যে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কয়েকজন কর্মী, কয়েকজন ত্রাণসহায়তাকর্মী এবং অন্তত একজন সাংবাদিকও ছিলেন। যাঁর হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি সম্ভবত একজন দোকানি।
বন্দুকের সাজানো ভিডিওটি পশ্চিমা দর্শকদের সামনে নিজেদের অপরাধগুলো ঢাকতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আরেকটি মরিয়া প্রচেষ্টার অংশ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি বালক, কিশোর ও পুরুষদের অপদস্থ করার ছবি ও ভিডিও প্রকাশের অন্য উদ্দেশ্যও আছে।
ইসরায়েলি জনসাধারণের মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের মনোবল ভেঙে দেওয়াই এর লক্ষ্য। এটি আসলে দখলদারির মানসিকতার সুস্পষ্ট প্রতিফলন। দখলদারদের চোখে ফিলিস্তিনিরা দমন-পীড়নের যোগ্য মানুষ, যদি না তাঁদের ইতিমধ্যে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।
এসব ছবি ও ভিডিও চিত্র এমন সময় প্রকাশ করা হয়েছে, যখন এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনি বালক, কিশোর ও পুরুষদের তাঁদের পরিবার থেকে আলাদা করছে। এরপর তাঁদের জোরপূর্বক অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
আর যাঁরা ছাড়া পেয়েছেন, তাঁরা ইসরায়েলি সেনাদের হাতে নির্যাতন ও মারধরের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। অনেকের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা অজানা রয়ে গেছে। ইসরায়েলি কারাগারে কমপক্ষে ছয়জন ফিলিস্তিনি বন্দী মারা গেছেন। ব্যাপক নির্যাতন ও অন্যান্য দুর্ব্যবহারেরও খবর বেরিয়েছে। ফলে তাঁদেরও দুর্ব্যবহারের মুখোমুখি হওয়ার বেশ আশঙ্কা রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও এবং ছবিগুলো বন্দীদের কয়েকজনকে শনাক্ত করতে সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের সাহায্য করেছে। এতে তাঁরা হামাস যোদ্ধা—ইসরায়েলের এমন দাবি যে অসত্য, তা প্রমাণ করা গেছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ ও কর্মসংস্থানবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) তহবিল সংগ্রহ করা যুক্তরাষ্ট্রের একটি দাতব্য সংস্থায় কাজ করেন হানি আলমাদাউন। তিনি বলেন, তাঁর ভাই মাহমুদের সঙ্গে ২৭ বছর বয়সী ভাতিজা আবুদকেও বন্দীদের মধ্যে দেখেছেন। মাহমুদ একজন দোকানি। হানি গার্ডিয়ানকে আরও বলেন, তাঁর বাবা এবং ১৩ বছর বয়সী আরেক ভাতিজা ওমরকেও আটক করা হয়েছে।
আল-আরাবি আল-জাদিদ নামে একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদক দিয়া আল-কাহলোতকে তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ধরে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। একটি ভিডিওতে সহকর্মীরা তাঁকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। সংবাদমাধ্যমটি জানায়, ইসরায়েলি সেনারা বাড়ি থেকে তাঁদের দুজনকে আটক করে। তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের বের করে দিয়ে পরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ ধরনের অবমাননাকর ছবি প্রকাশ করা জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন। ‘নিষ্ঠুর আচরণ ও নির্যাতন’ এবং ‘ব্যক্তির মর্যাদার ওপর আঘাত, বিশেষ করে অপমানজনক এবং অবমাননাকর আচরণ’ এ আইনে নিষিদ্ধ।
এসব ছবি ও ভিডিও বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনাকে ইরাকের আবু গারাইব কারাগার ও গুয়ানতানামোর মতো গোপন স্থানে বন্দী নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বসনিয়া যুদ্ধে সার্ব মিলিশিয়াদের গণহত্যা চালানোর কথাও আসছে।
এমনকি ইসরায়েলের লোকজনও এমন আচরণে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শলোমো ব্রম যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে বলেছেন, অবমাননাকর হওয়ায় ছবিগুলো প্রকাশ করা উচিত হয়নি।
এসব ছবি ও ভিডিও যদি গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আরেকটি অপরাধের বিষয় সামনে আনে, তাহলে কেন তারা এগুলো প্রকাশ করল। ব্রমের মতে, এর উদ্দেশ্য ছিল, ইসরায়েলিদের মনোবল বাড়ানো এবং ‘হামাসের বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ চালানো।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই পদ্ধতিগত অবমাননা নতুন কিছু নয়। ফিলিস্তিনি বিশ্লেষক রামজি বারুদের মতে, ‘ফিলিস্তিনিদের অপমান করাই প্রকৃত ইসরায়েলি নীতি।’ হারেৎজের প্রতিবেদক আমিরা হাস ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দীদের অপদস্থ করাকে একটি ‘নিত্যকৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
যদিও ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের লাঞ্ছনা সম্ভবত বাকি বিশ্বের নজর এড়িয়ে গেছে। তবে ফিলিস্তিনি বালক, কিশোর ও পুরুষদের প্রতি এ অবমাননাকর আচরণ গোটা বিশ্ব দেখেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি এই অবমাননাকর কাজগুলো ভাইরাল হতে সাহায্য করেছে।
৭ অক্টোবর থেকে ভাইরাল হওয়া অন্যান্য ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের বাড়ি দখলে নিয়ে সেখানে মলত্যাগ করছেন। একটি ফিলিস্তিনি দোকানে খেলনা ভাঙচুর করছেন এবং হাসছেন। তাঁরা ফিলিস্তিনি বন্দীদের নিপীড়নও করছেন।
ফিলিস্তিনি বালক, কিশোর ও পুরুষদের ওপর চালানো এ নিপীড়নের প্রচার তাঁদের অপমানকে আরও বাড়িয়ে তোলে। গ্রেপ্তার আর অবমাননাকর আচরণের ছবি প্রচারের মধ্যে ফারাক রয়েছে। এই ছবিগুলো সম্প্রচারমাধ্যমে অবমাননার বিষয়টি কেবল ওই মুহূর্তের মধ্যে কিংবা সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি একটি খোলা প্রদর্শনীতে পরিণত হয়, লাখো মানুষ তা দেখতে পারে।
মানুষের দুর্ভোগকে পণ্যের মতো তুলে ধরার ক্ষেত্রে ছবির ভূমিকা সম্পর্কে আমেরিকান বিশেষজ্ঞ সুসান সোনট্যাগ যা বলেছেন, সেটা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি বলছেন, ‘আলোকচিত্র মানুষকে পণ্যের মতো করে দেয়, যেন তারা হাতের মুঠোয় আনার মতো বস্তু।’
এ ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এসব আলোকচিত্র ভুক্তভোগীর দুর্ভোগকে উপভোগ করার মতো দেখায়। তাঁদের কেবলই কয়েকটি ছবি আকারে উপস্থাপন করে, যা ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং তাঁরা মানবিক আচরণ পাওয়ার অযোগ্য—এভাবে দেখা হয়। এই পণ্যকরণ ভুক্তভোগীদের স্বকীয়তা ও মর্যাদা কেড়ে নেয়; তাঁদের কেবলই অপমানের প্রতীকে পরিণত করে।
এতে আরেক দফায় ইসরায়েলি জনগণ ও বাকি বিশ্বের কাছে ফিলিস্তিনিরা মানবেতর প্রাণী এবং তাঁদের ‘অন্য (আমাদের চেয়ে ভিন্ন)’ হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যই পূরণ হয়। এটি ফিলিস্তিনি জনগণ ‘মানবেতর প্রাণী’ হিসেবে উপস্থাপন এবং তাঁদের ওপর চালানো গণহত্যাকে ন্যায্যতা দিতে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি প্রচারণারই অংশ।
এসব ছবি ও ভিডিওর প্রচার শুধু অবমাননাকর কাজের প্রমাণই নয়, এগুলো নিজেই একটি অবমাননাকর কাজ। এটি প্রাথমিক নিপীড়নের প্রভাবকে আরও বাড়ায়। এটি এভাবে দুর্ভোগের একটি মুহূর্তকে খোলামেলা অবমাননার প্রদর্শনী করে তোলে। ফলে ভুক্তভোগী ও তাঁদের সম্প্রদায়ের ওপর চালানো মানসিক এবং আবেগের ক্ষত আরও গভীর হয়।
শেষ পর্যন্ত এটি হামাসকে অপদস্থ করার বিষয় নয়। এটি হয়ে ওঠে সব ফিলিস্তিনিকে অবমাননা করা। তাঁদের মানবেতর প্রাণী হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মঞ্চে উপস্থাপন করা।
ভাষান্তর: মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম