ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বাসিন্দা আয়েশা শাতায়েহ। ৫০ বছর ধরে সপরিবার নিজ বাড়িতেই থাকতেন তিনি। পশুপালন করে চলত সংসার। কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে এক ব্যক্তি তাঁর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
আয়েশা বিবিসিকে বলেন, পশ্চিম তীরে তাঁর বাড়ির কাছে অবৈধ বসতি চৌকি গড়ে ওঠার পর থেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তাঁরা। ২০২১ সাল থেকে শুরু হয় এই হয়রানি ও ভয় দেখানো। হুমকি দেওয়া হয় বাড়ি ছাড়ার।
বিবিসির এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অবৈধ চৌকির সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। পশ্চিম তীরজুড়ে বর্তমানে এ ধরনের ১৯৬টি চৌকি আছে। এর মধ্যে গত বছরই গড়ে তোলা হয় ২৯টি, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
চৌকি নির্মাণে ইসরায়েলি সরকারের পরিকল্পনা কিংবা অনুমোদন কোনোটাই নেই। ইসরায়েলি আইনের অধীন পশ্চিম তীরজুড়ে বৈধ কিছু ইহুদি বসতি আছে। সেগুলো অপেক্ষাকৃত বড় ও সাধারণত শহরাঞ্চলে অবস্থিত। এসব বসতি অবৈধ চৌকিগুলোর মতো নয়।
একেকটি চৌকি বলতে একটি খামার, অনেকগুলো ঘরের সমষ্টি, এমনকি বেশ কয়েকটি কাফেলাকে বোঝাতে পারে। প্রায়ই এসব চৌকির নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা থাকে না। ইসরায়েলের নিজস্ব আইন ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, পশ্চিম তীরে এ ধরনের চৌকি স্থাপন পুরোপুরি বেআইনি।
কিন্তু ইসরায়েল সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু প্রতিষ্ঠান নতুন করে এ ধরনের চৌকি স্থাপন করার জন্য বসতি স্থাপনকারীদের অর্থ ও জমি দিয়ে সহায়তা করেছে। বিবিসি ওয়ার্ল্ডের হাতে আসা বেশ কিছু নথি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি বন্দোবস্তের তুলনায় এসব চৌকির মাধ্যমে খুব দ্রুত বড় জায়গা দখল করে নেওয়া যায়। তাই ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়নের ঘটনায় এসব চৌকির সম্পৃক্ততা ক্রমাগত বাড়ছে।
চৌকিগুলোর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো তথ্য নেই। তবে ইসরায়েলের অবৈধ বসতিবিরোধী দুই পর্যবেক্ষক দল পিস নাউ ও কেরিম নাভোটের সংগ্রহ করা চৌকির তালিকা এবং স্থান পর্যালোচনা করেছে বিবিসি। এ ছাড়া ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষও বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত একটি যুগান্তকারী মত দেন। এতে বলা হয়, ইসরায়েলের উচিত সব ধরনের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করা, ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়া। তবে আদালতের এ মতকে মৌলিকভাবে ‘ভুল ও একপক্ষীয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল।
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি যাচাই করে চৌকিগুলো কোথায় ও কবে স্থাপন করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে দেখেছে বিবিসি। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইসরায়েল সরকারের প্রকাশনা ও কিছু সংবাদমাধ্যমের সূত্র থেকে বিভিন্ন চৌকির তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলোতে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা বসবাস বা সেগুলো ব্যবহার করছেন।
বিবিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পশ্চিম তীরে ১৯৬টি চৌকির মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৮৯টি) গড়ে ওঠে ২০১৯ সালের পর। আর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর বাড়তে থাকা সহিংসতার সঙ্গে এসব চৌকির সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এ বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য আট অবৈধ বসতি স্থাপনকারীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও এতে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে দেওয়া হয় এ নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্যে অন্তত ছয়জন অবৈধ চৌকি স্থাপন করে এখনো বসবাস করছেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়ের ওপর অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের নজিরবিহীন সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই। পাশাপাশি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের প্রতি দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা এবং দোষীদের কঠোর হাতে দমন করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
আভি মিজরাহি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার। তিনি বলেন, বেশির ভাগ বসতি স্থাপনকারী আইন মেনে চলা ইসরায়েলি নাগরিক। তবে চৌকিগুলোর কারণে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যখনই আপনি ওই এলাকায় অবৈধভাবে চৌকি স্থাপন করবেন, তখন স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য তা উৎকণ্ঠা বয়ে আনবে।’
যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া উগ্র ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের একজন মোশে শারভিট। তিনিই আয়েশার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন। মোশের চৌকিটি আয়েশার বাড়ি থেকে ৮০০ মিটার দূরে।
এ বছরের মার্চে মোশে ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনের নির্মাণ করা চৌকির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তাঁর চৌকিকে বর্ণনা করা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা চালানোর ঘাঁটি হিসেবে।
আয়েশা বর্তমানে তাঁর সন্তানকে নিয়ে নাবলুস শহরের কাছে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘মোশে আমাদের জীবনকে নরকে পরিণত করছেন।’
চৌকি নির্মাণে ইসরায়েলি সরকারের পরিকল্পনা বা অনুমোদন কোনোটাই নেই। ইসরায়েলি আইনের অধীনে পশ্চিম তীরজুড়ে বৈধ কিছু ইহুদি বসতি আছে। সেগুলো অপেক্ষাকৃত বড় ও সাধারণত শহরাঞ্চলে অবস্থিত। এসব বসতি অবৈধ চৌকিগুলোর মতো নয়।
যদিও এ দুই ধরনের বসতিই আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। আইন অনুযায়ী, দখলকৃত এলাকা থেকে বেসামরিক জনগণকে স্থানান্তর করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তবে পশ্চিম তীরে বসবাস করা বসতি স্থাপনকারীদের দাবি, ইহুদি হিসেবে ওই ভূখণ্ডের সঙ্গে তাঁদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে।
গত জুলাইয়ে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত একটি যুগান্তকারী মত দেন। এতে বলা হয়, ইসরায়েলের উচিত সব ধরনের বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধ করা, ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেওয়া। তবে আদালতের এ মতকে মৌলিকভাবে ‘ভুল ও একপক্ষীয়’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল।
বৈধতা না থাকার পরও চৌকিগুলোর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঠেকাতে ইসরায়েল সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে এখনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি; বরং দেশটির সরকারের ঘনিষ্ঠ দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা পশ্চিম তীরে চৌকি স্থাপনে অর্থ ও জমি দিয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি।
এ দুই সংস্থার একটি ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন (ডব্লিউজেডও)। সংস্থাটি এক শতকেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিল। সংস্থার বসতি স্থাপনবিষয়ক বিভাগ ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের দখলকৃত এলাকার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত। বিভাগটিতে অর্থায়ন করা হয় ইসরায়েলের সরকারি তহবিল থেকে। এটিকে ইসরায়েলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখা হয়।
পিস নাউ নামের আরেকটি সংগঠনের হাতে আসা নথিপত্র ও বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পশ্চিম তীরে স্থাপন করা অবৈধ চৌকিগুলোকে অব্যাহতভাবে জমি বরাদ্দ দিয়ে গেছে ডব্লিউজেডওর বসতি স্থাপনবিষয়ক বিভাগটি।
এ–সংক্রান্ত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ডব্লিউজেডও কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারবে না। তাদের অধীন জমিগুলো শুধু পশুচারণ ও খামার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, অন্তত চারটি ক্ষেত্রে ওই বিভাগের জমিতে অবৈধভাবে চৌকি বানানো হয়েছে।
এসব চুক্তির একটিতে ২০১৮ সালে জেভি বার ইউসেফ নামের এক ব্যক্তি সই করেন। মোশে শারভিটের মতোই তাঁর ওপরও চলতি বছরের শুরুতে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা ও আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
পশুচারণ ও খামারের জন্য ডব্লিউজেডওর বরাদ্দকৃত বেশ কিছু জমি অবৈধ চৌকি স্থাপনে ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত কি না, জানার জন্য সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু এতে সাড়া দেয়নি সংস্থাটি। জানতে চাইলে জেভি বার ইউসেফের কাছ থেকেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিবিসি আরও দুটি নথিতে দেখেছে, আমানা নামের অন্য একটি সংস্থা পশ্চিম তীরে অবৈধ চৌকি স্থাপনে সহায়তা করতে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের।
এক বসতি স্থাপনকারীকে একটি চৌকিতে গ্রিনহাউস তৈরির জন্য ২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঋণ দেয় আমানা। ইসরায়েলি আইন অনুসারে এ ধরনের চৌকি স্থাপন অবৈধ।
আমানা ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনে ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে সংস্থাটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমানার বিরুদ্ধে অবৈধ চৌকি স্থাপনে সহায়তার বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আয়েশার পরিবারের মতো ভুক্তভোগী অনেক পরিবার বলেছে, মোশে শারভিটের হুমকির কারণে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তারা। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয় এসব পরিবার।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) বলছে, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। গত ১০ মাসে ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীরা এক হাজারের বেশি হামলা চালিয়েছে। গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাঁদের হাতে অন্তত ১০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২৩০ জন।
ওসিএইচএ আরও জানায়, একই সময়ে ফিলিস্তিনিদের হাতে পাঁচজন বসতি স্থাপনকারী নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা অন্তত ১৭।
সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল সরকারের মধ্যে ইতিমধ্যে নির্মিত চৌকিগুলোকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। গত বছর সরকার অন্তত ১০টি চৌকিকে বৈধ বসতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করে। ছয়টিকে ইতিমধ্যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী আয়েশা বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মোশে শারভিট তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেন। ২০২১ সালের শেষ দিকে তাঁর বাড়ির পাশে চৌকি স্থাপনের পর থেকেই মোশে তাঁর পরিবারকে নিপীড়ন ও ভয় দেখাতে শুরু করেন।
আয়েশার স্বামী নাবিল বলেন, তিনি চারণভূমিতে ছাগল চরাতে গেলেই মোশে তাঁর দলবল নিয়ে এসে ছাগলগুলো তাড়িয়ে দিতেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাঁদের বলেছি, সরকার বা পুলিশ বা বিচারক আমাদের বললে আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। জবাবে মোশে বলতেন, ‘‘আমিই সরকার, আমিই বিচারক, আমিই পুলিশ।’’’
এ বিষয়ে ফিলিস্তিন সরকারের উপনিবেশ ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা কমিশনের প্রধান মোয়াইয়াদ শাবান বলেন, চারণভূমিতে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি কৃষকদের অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, তাঁদের আর কিছু করার থাকে না। তাঁরা খেতে পারেন না, পশু চরাতে পারেন না, খাবার পানিও পান না।