ইজ্জেলদিন আবুইলাইশের সঙ্গে যখন ফোনে কথা হয়, তখন তাঁর শরীরে উড়োজাহাজে ভ্রমণের ক্লান্তি, কণ্ঠে বিষাদ। আবুইলাইশ ইসরায়েলের হাসপাতালে কর্মরত প্রথম ফিলিস্তিনি হিসেবে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হয়, তার কিছুক্ষণ আগে তিনি বর্তমান বাড়ি কানাডার টরন্টোতে পৌঁছেছেন।
আবুইলাইশ কয়েক দিন মিসরের কায়রোতে কাটিয়ে এসেছেন। গাজায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় তিন সন্তান হারানো ভাইকে সান্ত্বনা দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি।
এই দুঃখ-বেদনা সম্পর্কে আবুইলাইশের ভালোই অভিজ্ঞতা আছে। ২০০৯ সালে গাজায় নিজের বাড়িতে ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলার আঘাতে তাঁর ২১, ১৫ ও ১৩ বছর বয়সী তিন মেয়ে ও ১৭ বছর বয়সী ভাতিজি নিহত হয়। ইসরায়েলের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টেন টিভির লাইভে তাদের ভয়াবহ সেই ঘটনা বর্ণনা করার পর তিনি ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন।
২০০৮ সালের শেষ দিকে ও ২০০৯ সালের শুরুতে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়। তখন প্রতিদিন ইসরায়েলের টেলিভিশনে সাবলীল হিব্রুতে যুদ্ধের সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করেছেন আবুইলাইশ।
২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি আবুইলাইশ তাঁর বন্ধু ও চ্যানেল টেনের প্রতিবেদক সলোমি এলদারকে ফোন দেন। তিনি তখন মুঠোফোনে আবুইলাইশের ভয়েস মেসেজ পড়ার সময় স্পিকার অন করে দেন, যা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হয়।
টেলিভিশনের সেই মুহূর্তটি উপস্থাপক ও ইসরায়েলের দর্শকদের অন্তর কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ফোন সচল রেখেই সন্তান হারানোর দুঃখ নিয়ে আবুইলাইশ বলছিলেন, ‘আল্লাহ, আল্লাহ, আমরা কী করেছি?’
ওই দিন পরিবারের আহত সদস্যদের ইসরায়েলের একটি হাসপাতালে ভর্তি করান আবুইলাইশ। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা নিয়েই সংবাদমাধ্যমের সহায়তায় সাম্য ও শান্তির পক্ষে প্রচারণা চালান তিনি।
সেখানে ‘জীবন’ বলতে কিছুই নেই। আপনি ত্রাণের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছেন। পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।ইজ্জেলদিন আবুইলাইশ, ফিলিস্তিনি চিকিৎসক
পাঁচবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত (৬৮) এই ফিলিস্তিনি চিকিৎসক বেঁচে থাকা সন্তানদের নিয়ে কানাডায় বসবাস শুরু করেন। তিনি এখন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর দাল্লা লানা পাবলিক হেলথ স্কুলে অধ্যাপনা করছেন।
টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের মধ্যে ফোন করার প্রায় ১৫ বছর পর গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় আবারও আবুইলাইশ তাঁর পরিবারের মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে লড়াই করে চলছেন।
এবার গত অক্টোবরের শেষ দিকে গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় আবুইলাইশের যৌথ পরিবারের ২০ জনের বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন।
সিএএনের মতামত বিভাগকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের চিকিৎসকদের সঙ্গে কাজ করতে চাওয়ার কারণ, গাজার হাসপাতালগুলোর ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং প্রতিটি ফিলিস্তিনি শিশুর মধ্যে কেন তিনি নিজের মেয়েদের দেখতে পান—সেসব বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে।
সিএনএন: গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে কাটানো ছোটবেলা সম্পর্কে কিছু বলুন।
ইজ্জেলদিন আবুইলাইশ: সেখানে ‘জীবন’ বলতে কিছুই নেই। আপনি ত্রাণের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছেন। পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
সেই সময় অন্তত সবার জন্য পানি সহজলভ্য ছিল। বর্তমানে পানিও নেই। খাবার নেই। এটি চরম দারিদ্র্য। এটি বৈষম্য। আপনি সেখানকার মানুষের দুর্দশা, হতাশা বুঝতে পারবেন।
১৯৭০ সালে ইসরায়েলের বাহিনী আমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাড়ি বলতে কী বোঝায়? বাড়ি হলো আপনার মর্যাদা। আপনার স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, পরিবার ও জীবন। এটি শুধু চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তার চেয়েও বড় কিছু।
আমাদের দুই কক্ষের খুবই সাদাসিধা একটি বাড়ি ছিল। কিন্তু এটি শীত ও সূর্য থেকে আমাদের সুরক্ষিত রেখেছিল। যখন বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে যায়, তখন এর সঙ্গে মর্যাদা, স্বাধীনতা ও গোপনীয়তারও ইতি ঘটল।
সিএনএন: আপনি ইসরায়েলের হাসপাতালে প্রথম ফিলিস্তিনি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সীমান্তের ওপারে কাজ করে আপনি কী শিখলেন?
ইজ্জেলদিন আবুইলাইশ: আমার কাছে চিকিৎসকেরা হলেন মানবতার বার্তাবাহক। তাঁরা মানবতা ছড়িয়ে দেন, আহত ব্যক্তিদের সুস্থ করে তোলেন। আর আমরা যখন চিকিৎসা করি, তখন রোগের ভিত্তিতে সবাইকে সমানভাবে সেবা দিই। নাম, জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ভিত্তিতে নয়।
আমি যখন সেখানে কাজ করতাম, তখন ইসরায়েলের চিকিৎসকদের কাছ থেকে শিখতে ও বুঝতে চাইতাম। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি কারা, সেটিও জানতে চাইতাম। কারণ, আমাদের শত্রু হলো আমাদের অজ্ঞতা, মূর্খতা ও লোভ। আপনার সম্পর্কে না জেনে আপনাকে কীভাবে বিচার করব?
আমি চেয়েছিলাম, সেখানে যেসব ফিলিস্তিনি কাজ করে, তাদের যেন শুধু শ্রমিক হিসেবে না দেখা হয়। অথবা প্রথম ইন্তিফাদার সময় যেসব শিশু পাথর নিক্ষেপ করেছিল, তাদের মতো বিবেচনা না করা হয়।
সিএনএন: ২০০৯ সালে আপনার ফোনকলের পর ইসরায়েলের টেলিভিশনে ট্যাংকের গোলার আঘাতে গাজায় আপনার বাড়িতে তিন মেয়ে ও ভাতিজি হত্যার ভয়াবহ ঘটনা প্রচার হয়। সেই মুহূর্ত ইসরায়েলিদের কীভাবে নাড়া দিয়েছিল?
আবুইলাইশ: ওই সময় (২০০৮ সালের ডিসেম্বর ও ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময়) চারপাশে বোমা ও গোলাবর্ষণের কারণে দিন–রাত কখনোই জানালার কাছে যেতে পারতাম না। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি সেই সময়ের অভিজ্ঞতায় চেয়ে আরও বেশি খারাপ।
আমার ছয় মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান ছিল। তাই তিনজনকে একটি দেয়ালের পাশে ও অপর তিনজনকে আরেকটি দেয়ালের আড়ালে রাখতাম। আর অন্যরা বাকি দেয়ালের পেছনে থাকতাম। কোনো একদিক থেকে হামলা হলে যাতে সবাই একসঙ্গে মারা না যায়, সে জন্য এটা করতাম।
সেদিন আমি যখন ধোঁয়া, ধূলা আর ধ্বংস দেখতে পেলাম, প্রথমে আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। পরে বুঝতে পারলাম, এটি আমার বাড়ি।
আমি বাড়িতে ঢুকে দেখতে যাই, যেখানে আমার বড় মেয়ে বেসান ছিল। মাকে হারানোর পর (আবুইলাইশের স্ত্রী আগের বছর লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান) সে মায়ের ভূমিকা পালন করছিল। মায়ার কোথায়? ১৫ বছরের মায়ার চিকিৎসক হতে চেয়েছিল। মাথা থেকে তার শরীর আলাদা হয়ে গিয়েছিল।
১৩ বছরের আয়া সাংবাদিক হতে চেয়েছিল। আর আমার ভাতিজি নূর (১৭) ওই দিন সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে এসেছিল। চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। তাদের শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। তাদের রক্ত ও মগজ ছাদে ও মেঝেতে লেগে ছিল।
এমন মুহূর্তে আমি কী করতে পারি? গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি নিয়ে ইসরায়েলের টেলিভিশনে আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল। তখন আমি সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করে কী ঘটেছে, তা জানাই। তাকে একটি ভয়েস মেসেজ পাঠাই। সৌভাগ্যবশত তিনি ওই সময় টিভি উপস্থাপিকার সঙ্গে বসে ছিলেন, যিনি আমার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন।
আমার বন্ধু ওই উপস্থাপিকাকে বলেছিলেন, আবুইলাইশের কিছু একটা হয়েছে। তখন তিনি লাউড স্পিকার চালু করেন। স্টুডিওতে কী ঘটছে, আমি জানতাম না। তার কাছে জানতে চাইলাম, বাড়িতে হামলা বন্ধ করতে এবং আহত ও নিহতদের উদ্ধার করতে কী করা যায়।
আমার মেয়ে শাথার চোখ বের হয়ে গিয়েছিল এবং দুটি আঙুল আলাদা হয়েছিল। সে হাঁপাচ্ছিল। সুতরাং ওই মুহূর্তে আমি ফোন করেছিলাম। আমি যে হাসপাতালে কাজ করি, সেখানে তাদের (মেয়েদের) নিতে পারি কি না, সেই চেষ্টা করেছিলাম। আর তখন এটি ইসরায়েলের টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হয়।
এর মাধ্যমে তাদের দেখিয়ে দিল, এরা ফিলিস্তিনি জনগণ। এই সেই চিকিৎসক, যিনি আমাদের চিকিৎসা করছেন, আমাদের সন্তানের ডেলিভারি করাচ্ছেন। আর এরা হচ্ছে তার মেয়ে, যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করত।