প্রায় ছয় মাস ধরে চলা ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হামলা থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতালগুলোও। জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার হামলায় গাজার দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল সেবাদানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে করে চরম দুর্দশার মধ্যে দিন পার করছেন বোমা–গুলিতে আহত হাজারো ফিলিস্তিনি।
গাজার হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ক সংস্থা ইউএনওসিএইচএ বলেছে, উপত্যকাটির যেসব হাসপাতাল এখনো চালু আছে, সেগুলোও পূর্ণ মাত্রায় চিকিৎসাসেবা দিতে পারছে না। দক্ষিণের হাসপাতালগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ফিলিস্তিনি এ ভূখণ্ডের ৩৬টি হাসপাতালের দুই-তৃতীয়াংশই ইসরায়েলের হামলায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কোনোরকমে সেবা দিতে পারছে মাত্র ১২টি হাসপাতাল।
ইউএনওসিএইচএর তথ্য অনুযায়ী, ১০ দিন ধরে গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকার আল-শিফা হাসপাতাল অবরোধ করে রেখেছেন ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরা। হাসপাতালে চিকিৎসাকর্মী ও রোগীদের এমন একটি ভবনে আটকে রাখা হয়েছে, যেটি আগে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহার করা হতো। ওই ভবনে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই।
ঘটনাস্থল থেকে আল-জাজিরার সংবাদদাতা জানিয়েছেন, ১৮ মার্চ আল-শিফা হাসপাতালে ট্যাংক নিয়ে হামলা চালায় ইসরায়েল। এর পর থেকে হামলা অব্যাহত রয়েছে। এতে হাসপাতাল ভবনের পাশাপাশি আশপাশের ঘরবাড়িও ধ্বংস হচ্ছে। হাসপাতালটিতে মুহাম্মদ আবু শাকিল নামের এক ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
ইসরায়েল বলেছে, গত ১০ দিনে আল-শিফা হাসপাতাল ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে তারা। হাসপাতাল থেকে বেসামরিক মানুষ, রোগী ও চিকিৎসাকর্মীদের ‘বিকল্প স্থাপনায়’ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে জেনেভাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের ভাষ্য, ১০ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে অন্তত ১৩ শিশুসহ বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবার ও পানির অভাবে রাফার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে তীব্র মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। হাসপাতালের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেখানে প্রতিদিন গড়ে অপুষ্টির শিকার ১৫ শিশু ভর্তি হচ্ছে। দক্ষিণে খান ইউনিসের আল-আমাল হাসপাতালের প্রবেশপথগুলো আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে দিয়েছেন ইসরায়েলি সেনারা। এই এলাকার ইউরোপিয়ান গাজা হাসপাতালের অবস্থাকে ‘বর্ণনার অতীত’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু দক্ষিণ গাজা নয়, উপত্যকাটির অন্য এলাকার হাসপাতালগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। যেমন মধ্য গাজার দের আল-বালাহ এলাকার আল-আকসা মার্টায়ার্স হাসপাতাল। সেখানে চিকিৎসকদের একটি দলে আছেন লেবাননের শিশুবিশেষজ্ঞ তানিয়া হাজ-হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দল পাঁচ দিন ধরে চিকিৎসা দিয়েই যাচ্ছে। আমরা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি। কল্পনাও করতে পারি না, টানা ১৬২ দিন ২৪ ঘণ্টা করে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছাড়া গাজার চিকিৎসকেরা কীভাবে কাজ করছেন!’
আল-আকসা মার্টায়ার্স হাসপাতালে বর্তমানে ৮০০ জনের মতো রোগী ভর্তি আছেন। তবে সেখানে শয্যা মাত্র ১৬০টি। বাকিরা মেঝে ও বারান্দায় বিছানা পেতে আছেন। হাসপাতালে যে কয়েকজন চিকিৎসক ও কর্মী রয়েছেন, তাঁদের দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। তাঁদের অনেকে ইসরায়েলের হামলায় পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন।
হাসপাতালটিতে জর্ডান থেকে আসা চিকিৎসাকর্মী মুস্তফা আবু কাসিম বলেন, চিকিৎসক দলের সদস্যরা তাঁদের সর্বোচ্চটা দিচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগই সন্তান, স্ত্রী বা মা-বাবাকে হারিয়েছেন। এরপরও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বোঝা যায়, তাঁরা কতটা মানসিক চাপে রয়েছেন।
শুধু জাতিসংঘ নয়, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে মানবিক সহায়তা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ। তারা বলছে, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের পাশাপাশি উত্তর গাজার হাসপাতালগুলোর ‘বেশির ভাগই’ ধ্বংস হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ‘ধসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে’।
এমন পরিস্থিতিতে গাজার হাসপাতালগুলোতে হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) তিনি বলেছেন, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোনোমতে টিকে আছে। আরও একবার উপত্যকাটির হাসপাতালগুলোতে হামলা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে ডব্লিউএইচও।
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গতকাল বৃহস্পতিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৩২ হাজার ৫৫২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আগের ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন ৬২ জন। আর হামলা শুরুর পর থেকে আহত হয়েছেন অন্তত ৭৪ হাজার ৯৮০ ফিলিস্তিনি। হতাহতদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী।