ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার চার মাস পূরণ হলো আজ মঙ্গলবার। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এ সংঘাতে ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে উপত্যকাটি। ইসরায়েলের হামলায় বেড়েই চলেছে ফিলিস্তিনিদের লাশের সারি। এক অসহায় ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ কোজাতের ভাষ্য, ‘কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। আমরা কোথায় যাব?’
মোহাম্মদ কোজাত কথাগুলো বলেন গাজার একেবারে দক্ষিণে সীমান্তবর্তী রাফা এলাকা থেকে। ইসরায়েলের হামলার মুখে প্রাণ বাঁচাতে গত চার মাসে উপত্যকাটির বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে এই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই এখন রাফায় অবস্থান করছেন। সেখানে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যেও হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের হামলা থেমে নেই উপত্যকাটির অন্যান্য অঞ্চলেও। আজ মঙ্গলবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় ২৭ হাজার ৫৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬৬ হাজার ৯৭৮ ফিলিস্তিনি। নিহত মানুষদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার শিশু এবং ৮ হাজার নারী রয়েছেন। অপর দিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের হামলায় নিহত প্রায় ৪০০ জন।
গাজা কর্তৃপক্ষ আজ বলেছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন ১২৭ জন। এ সময় সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয়েছে দক্ষিণের খান ইউনিসে। সেখানে রাতভর চলেছে বোমাবর্ষণ ও স্থলহামলা। স্থানীয় ফিলিস্তিনি ও চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন, খান ইউনিসের নাসের ও আল–আমাল হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ইসরায়েলের ট্যাংক। হাসপাতালের চত্বরে বোমাও ফেলা হয়েছে।
আজ হামলা হয়েছে রাফায়ও। এর জেরে সেখানে আরও বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া লাখো মানুষের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উত্তরে গাজা নগরীতে আজকের হামলায় বেশ কয়েকটি ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলমান সংঘাতে উপত্যকাটিতে ৪ হাজার ৮৯৫ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার জন। একই সময়ে গাজায় ২৩৯ শিক্ষক নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, গত চার মাসে গাজায় তাদের ৬৫টি ও সরকারি ২৮৬টি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।
ইসরায়েলের হামলায় ভেঙে পড়েছে গাজার অবকাঠামোও। জাতিসংঘ ও গাজা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, ৭ অক্টোবরের পর থেকে উপত্যকাটির প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ৩৫টির মধ্যে হাসপাতাল আংশিক চালু আছে মাত্র ১৩টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজার ২২১টি প্রার্থনালয়। প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন প্রায় ১৯ লাখ মানুষ।
ইসরায়েলের হামলা ও অবরোধে খাবার, পানি, জ্বালানি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে মানুষ চরম সংকটে রয়েছেন। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থা ওসিএইচএ জানিয়েছে, গত জানুয়ারি মাসে তারা গাজায় যে ত্রাণসহায়তার পরিকল্পনা করেছিল, ইসরায়েলের বাধার কারণে তার ৬৬ শতাংশই পূরণ হয়নি। এতে সবচেয়ে দুর্দশায় রয়েছে গাজার শিশুরা।
ওসিএইচএ জানিয়েছে, গাজায় শিশুদের মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। শিশুদের মা–বাবারাও সংকটে রয়েছেন। সংকটের কারণে তাঁরা সন্তানের জরুরি ফর্মুলা দুধ দিতে পারছেন না।
৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে হামলা চালালে গাজা সংঘাত শুরু হয়। ওই হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হয়েছিলেন। ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করেছিল হামাস। নভেম্বরে গাজায় যুদ্ধবিরতির সময় তাঁদের কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আরও জিম্মির মুক্তি ও নতুন করে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে আবার শুরু হয়েছে তৎপরতা।
সম্প্রতি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব আনা হয়। ওই প্রস্তাবে সায় দেয় ইসরায়েল। তবে হামাসের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার ও মিসর। যুদ্ধবিরতির এ তৎপরতাকে আরও এগিয়ে নিতে বর্তমানে পঞ্চমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। আজ সৌদি আরব সফর করেছেন তিনি। ইসরায়েল ভ্রমণের আগে কায়রো ও দোহায়ও যাবেন।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়েমেনের কাছে ড্রোন হামলায় ব্রিটেনের মালিকানাধীন একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হোদেইদা অঞ্চলের পশ্চিমে লোহিত সাগরে এ ঘটনা ঘটে। আজ সাগরপথের নিরাপত্তাবিষয়ক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান আমব্রে জানিয়েছে, এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি।
ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা গত কয়েক মাসে লোহিত সাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। তারা বলছে, গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে তারা এটা করছে। এসব হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতিদের লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালাচ্ছে।
এদিকে গতকাল সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রাশিয়া ও চীনের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে। মস্কো ও বেইজিংয়ের ভাষ্য, ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্য করে চালানো মার্কিন বাহিনীর হামলা অঞ্চলটিতে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।