লেবাননে আকাশ ও স্থলপথে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। রাজধানী বৈরুতের পাশাপাশি দেশটির সীমান্ত এলাকায়ও বোমাবর্ষণ করছে তারা। আজ শুক্রবার লেবানন ও সিরিয়ার মধ্যে একটি সীমান্ত ক্রসিংয়ে ব্যাপক হামলা হয়েছে। ইসরায়েলের হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে এই পথে সিরিয়া পাড়ি দিচ্ছেন লেবাননের অনেক বেসামরিক নাগরিক।
লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে মাসনা নামের ওই ক্রসিংয়ে ইসরায়েলের হামলার ফলে সড়কপথের বড় একটি অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। চলাচল করতে পারছে না যানবাহন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি—ওই ক্রসিংয়ে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। সীমান্তটি দিয়ে লেবাননে অস্ত্র চোরাচালান করা হতো।
মাসনা ক্রসিংয়ে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও এখনো অনেকে হেঁটে সিরিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। আজ তোলা ছবিতে দেখা গেছে, লেবানন থেকে পালাতে সড়কের বড় বড় গর্ত পার হচ্ছেন লোকজন। বোমার আঘাতে ওই গর্তগুলো সৃষ্টি হয়েছে। লেবানন সরকারের হিসাবে, গত ১০ দিনে ইসরায়েলের হামলার মুখে দেশটি থেকে ৩ লাখের বেশি মানুষ সিরিয়ায় পালিয়ে গেছেন।
* ইসরায়েলের হামলায় লেবাননের কমবেশি ১০ লাখ মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে।* ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে উদ্বাস্তু হওয়ার সংখ্যা সর্বোচ্চ খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে।* লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে মাসনা ক্রসিংয়ে ইসরায়েলের হামলা।* বৈরুতেও ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
মাসনা ক্রসিংয়ে সড়কে হামলার ফলে শুধু মানুষের চলাচলই বিঘ্ন হচ্ছে না, সেখান দিয়ে খাদ্যসামগ্রী ও মানবিক সহায়তা আনা-নেওয়ায়ও সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণসংক্রান্ত কর্মকর্তারা। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ম্যাথিউ হোলিংওর্থ বলেন, মাসনা সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে লেবাননে সবচেয়ে কম খরচে ও সহজে বিভিন্ন পণ্য আনা যেত। হামলার ফলে তা আর সম্ভব হবে না। এখন ইসরায়েলের অন্য সীমান্তপথগুলোতে হামলা চালানো উচিত হবে না। কারণ, বর্তমানে সেগুলো মানুষের দেশত্যাগ ও ত্রাণসহায়তা আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আজ বৈরুতেও ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। হামলা হয়েছে রাজধানীর দক্ষিণ উপকণ্ঠের কাছে লেবাননের একমাত্র বাণিজ্যিক বিমানবন্দর বৈরুত-রাফিক হারিরি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। এ ছাড়া আজ ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য প্রধান হাশেম সাফিয়েদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে আরও দুই ডজন শহর ও গ্রামের বাসিন্দাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দ্রুত সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এই শহরগুলো ইসরায়েল সীমান্ত থেকে লেবাননের প্রায় ৩০ কিলোমিটার ভেতরে—লিতানি নদীর উত্তরে। এর মধ্য দিয়ে লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চল ইসরায়েলের দখলে যাওয়ার পুরোনো শঙ্কা আবার দেখা দিয়েছে।
ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। ২০০৬ সালে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধও হয়েছিল। এরপর গত বছর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হামাসের সমর্থনে ইসায়েলে আবার হামলা শুরু করে হিজবুল্লাহ। জবাবে পাল্টা হামলা চালাচ্ছিল ইসরায়েলও। তবে গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে হামলা জোরদার করে তারা। এতে হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা নিহত হন। সাম্প্রতিক হামলায় লেবাননে নিহত মানুষের মোট সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৩৭ জন মারা গেছেন। নতুন করে আহত ১৫১ জন।
চরম ‘বিপর্যয়ে’ বেসামরিক মানুষ
লেবাননে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার ফলে বেসামরিক মানুষ ‘সত্যিকার অর্থে বিপর্যয়ের’ মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক ও মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়ক ইমরান রিজা। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের হামলায় লেবাননের কমবেশি ১০ লাখ মানুষের ওপর প্রভাব পড়েছে। ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে উদ্বাস্তু হওয়ার সংখ্যা সর্বোচ্চ খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বেসামরিক স্থাপনাগুলোয় খুব বেশি পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে মানুষের আতঙ্ক চরমে পৌঁছেছে।
আজ জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা রুহা আমিন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর লেবাননের প্রায় ৯০০টি সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে হামলার কারণে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের ভিড়ে সেগুলোয় আর জায়গা নেই। ফলে অনেককে এখন উন্মুক্ত স্থান, রাস্তা ও পার্কগুলোতে রাত কাটাতে হচ্ছে।
এদিকে লেবাননের প্রবাসী নারী গৃহকর্মীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটিতে আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থার প্রধান ম্যাথিউ লুসিয়ানো। তিনি বলেছেন, চলমান সংঘাতের মধ্যে অনেক গৃহকর্মীর নিয়োগদাতারা তাঁদের চাকরিচ্যুত করেছেন। এই গৃহকর্মীদের অনেকের কাছে বৈধ কাগজপত্র নেই। ফলে গ্রেপ্তার হওয়া এবং লেবানন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার শঙ্কায় তাঁরা মানবিক সহায়তার খোঁজ করতে ভয় পাচ্ছেন।