ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা

তীব্র উত্তেজনায় ফুটছে মধ্যপ্রাচ্য, যুদ্ধ বাধতে পারে যেকোনো সময়

ইরানের রাজধানী তেহরানে শক্তিশালী রেভল্যুশনারি গার্ডের অতিথিশালায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টায় হামলায় নিহত হন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া
ইরানের রাজধানী তেহরানে শক্তিশালী রেভল্যুশনারি গার্ডের অতিথিশালায় মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টায় হামলায় নিহত হন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া

হামাসের নেতাকে ইরানের রাজধানী তেহরানের এক অতিথিশালায় হত্যার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার মধ্যেই লেবানন ও ইরানের ভেতর একাধিক ইসরায়েলি হামলায় পাল্টা প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়েছে ইরান ও তার প্রক্সি হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিরা। এতে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইরান নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা পারমাণবিক উত্তেজনা, শত্রুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে নতুন প্রেসিডেন্টরা অনেক সময় পেয়েছিলেন। কিন্তু দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান পেলেন মাত্র ১০ ঘণ্টা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শপথ গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশটির রাজধানী তেহরানে শক্তিশালী রেভল্যুশনারি গার্ডের অতিথিশালায় রাত ২টায় হামলায় নিহত হলেন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা হানিয়াকে ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ও দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের পক্ষ থেকে এ হামলাকে ইসরায়েলের লজ্জাজনক কাজ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

পেজেশকিয়ান ও খামেনির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হাতে ইসরায়েলে হামলা করা ছাড়া আর ভিন্ন কোনো পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। পেজেশকিয়ান তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনটি তাই কাটিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। গত বুধবার তাঁদের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে সরাসরি হামলার নির্দেশ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।

এর আগে হানিয়া নিহত হওয়ার পর এক এক্স বার্তায় প্রতিশোধের বার্তা দেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি লিখেছেন, ‘ইরানের সীমানার মধ্যে ঘটা এমন তিক্ত ও দুঃখজনক ঘটনার পর প্রতিশোধ নেওয়াটা আমাদের কর্তব্য।’

গত এপ্রিলে ইসরায়েলে এক দফা হামলা চালিয়েছিল ইরান। অবশ্য ওই সময় ইরানের ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই আকাশে থাকা অবস্থায় চার দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, জর্ডান ও যুক্তরাজ্য) জোট ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। এবারে ইরান কীভাবে প্রতিশোধ নিতে চায়, তা এ সংঘাতে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ইরান যদি আগের মতোই সরাসরি হামলা চালায়, তাহলে উত্তেজনা আরও বেড়ে যাবে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ঘনিষ্ঠ লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ যদি ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে হামলা করে বা সিরিয়ার হুতিরা যদি লোহিত সাগরে তাদের হামলা আরও বাড়ায়, তাহলে যুদ্ধ লেবানন ও সিরিয়ায় আরও ছড়িয়ে পড়বে। ৯ মাসের বেশি সময় ধরে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমিক আন্তসীমান্ত সংঘাত চলছে। এ সময় ইসরায়েলে হামলা চালাতে নানা রকম অস্ত্র ব্যবহার করেছে হিজবুল্লাহ। বিশ্বের অন্যতম অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ভান্ডারে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আছে। বলা হয়ে থাকে যে অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হিজবুল্লাহর কাছেই সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের মজুত আছে। এ ক্ষেত্রে লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল চালু রাখতে মার্কিন নৌবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

এর বাইরে আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ উপায় আছে ইরানের হাতে। সেটি হলো, তাদের পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করা। কয়েক দশক ধরে তারা এ পথে হেঁটেছে। তারা পারমাণবিক জ্বালানি তৈরি ও সম্প্রতি বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়ামের সংগ্রহ সমৃদ্ধকরেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা মনে করেন যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। তবে ইরানের নেতারা সম্প্রতি সরাসরি এ পথে হাঁটার কথা বিবেচনা করছেন বলে জনসম্মুখে বলেছেন।

হানিয়া হত্যার জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের খানানি বলেছেন, হানিয়ার রক্ত কখনোই বৃথা যাবে না। এর ফলে গাজায় যুদ্ধ চলার মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। হানিয়ার আগেই লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর এক নেতাকে হত্যার দাবি করে ইসরায়েল। ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে ইরান–সমর্থিত দুই সশস্ত্র সংগঠনের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার হত্যাকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নতুন করে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অভিপ্রায় ইরানের আছে। কারণ, হামাস নেতাকে হত্যার ঘটনায় ইরান সরকারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর জেরে মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। বুধবার এ নিয়ে জরুরি বৈঠক আয়োজন করা হয় নিরাপত্তা পরিষদে। সেখানেও ছড়ায় উত্তাপ।