দীর্ঘ ১৩ বছরের ধ্বংসযজ্ঞের পর অবশেষে সিরিয়া গৃহযুদ্ধের একটা পরিণতি দেখলেন বিশ্ববাসী। দেশটির নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদ বিদ্রোহীদের ঝোড়ো আক্রমণের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দামেস্ক থেকে মস্কোর উদ্দেশ্যে পালিয়েছেন।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত রোববার বলেছে, সিরিয়া আরব প্রজাতন্ত্রে সশস্ত্র লড়াইয়ে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষের উল্লেখযোগ্য অংশের সঙ্গে আলোচনার পর বাশার আল–আসাদ দেশটির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি দেশ ছেড়েছেন ও সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলেছেন।
মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ওই সমঝোতায় কোনো ভূমিকা না রাখলেও সিরিয়ার বিরোধী সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে রাশিয়া।
রাশিয়া ‘বিরোধী পক্ষ’ বলতে প্রেসিডেন্ট বাশারকে হটিয়ে সিরিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বুঝিয়েছে। সিরীয় বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা রাশিয়ার অবস্থানের এক বড় বাঁক বদল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেননা, গেল সপ্তাহেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আল জাজিরাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কর্কশ ভাষায় ওই গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করেন।
সিরিয়া থেকে আসাদকে হারিয়ে ফেলা পুতিনের মানসম্মানের জন্য নিশ্চিতভাবেই এক ধাক্কা। তবে সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্যে পুতিনের যে অবস্থান, তাতে এটি বিরাট কোনো পরিবর্তন বয়ে আনবে না।পল সালেম, মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ
প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভে ব্যাপক দমনাভিযান চালানোর জের ধরে সিরিয়ায় ২০১১ সালে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ২০১৫ সালে দেশটির অভ্যন্তরীণ এ সংঘাতে রাশিয়া নিজেকে জড়িয়ে বাশারের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে প্রমাণ করে।
জাতিসংঘে আসাদকে জোর কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সিরিয়ায় তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিমানশক্তি পর্যন্ত মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। বিরোধীদের ওপর বছরের পর বছর জুলুম–নির্যাতনের পরও আসাদের গদি ঠিক থাকার পেছনে অনেকটাই রাশিয়াকে কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন বিশ্লেষকেরা।
এমন জোরাল সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ার ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী তারতুস পর্যন্ত তাঁর দেশের নৌঘাঁটি সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হন। সেই সঙ্গে, এর কাছাকাছি হেইমিমে বিমানঘাঁটি স্থাপন করেন। ২০১৫ সাল থেকে এটি চালু আছে।
দুটি ঘাঁটিই সিরিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় প্রদেশ লাতাকিয়ায় অবস্থিত। এ দুই ঘাঁটি রাশিয়ার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার অংশ। আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকাজুড়ে প্রভাব বিস্তারমূলক কার্যক্রম চালানোয় ঘাঁটি দুটি ব্যবহার করে আসছে মস্কো।
মার্ক গ্যালোটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মায়াক ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। পুতিন ও রাশিয়া বিষয়ে কয়েকটি বইয়ের রচয়িতাও তিনি। গ্যালোটি বলেন, ‘রাশিয়ার জন্য সিরিয়ায় থাকা দুটি ঘাঁটিই গুরুত্বপূর্ণ।’
সিরিয়ার বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা রাশিয়ার অবস্থানের এক বড় বাঁকবদল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কেননা, গেল সপ্তাহেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আল জাজিরাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে কর্কশ ভাষায় ওই গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যায়িত করেন।
মস্কো গত দুই বছর ধরে ইউক্রেনে অভিযান চালানো নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও লিবিয়া, সুদান ও মধ্য আফ্রিকা নিয়ে তার উদ্বেগ আছে। তবে এসব এলাকায় নিজের প্রভাব বিস্তার করা এবং তা ধরে রাখা অনেকটাই নির্ভর করছে লাতাকিয়ায় থাকা ওই দুই ঘাঁটির ওপরে।
গ্যালোটি বলেন, ‘তুরস্ক বসফরাস প্রণালি হয়ে কোনো যুদ্ধজাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয় না। এর অর্থ হলো, সিরিয়ার তারতুসে নিজস্ব নৌঘাঁটি ছাড়া ভূমধ্যসাগরে নৌশক্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার একমাত্র পথ থাকবে বাল্টিক সাগর, যেটি খুব কম সুবিধাজনক।’
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘একইভাবে হেইমিমের বিমানঘাঁটি ছাড়া আফ্রিকায় নিজেদের কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিমান সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে তুরস্কের সদিচ্ছার ওপর। এ ধরনের পরিস্থিতি ক্রেমলিনের জন্য সুখকর নয়।’
ক্রেমলিনের একটি সূত্রের বরাতে রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স বলেছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাত করার পর দৃশ্যত এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ওই দুই ঘাঁটি ও তাদের কর্মীরা নিরাপদ আছেন। তবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কতক্ষণ পাওয়া যাবে, সে ব্যাপারে কোনো ইঙ্গিত দেয়নি সূত্রটি।
অবশ্য, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু রুশ ব্লগার সতর্ক করে বলেছেন যে, নৌ ও বিমানঘাঁটি ঘিরে পরিস্থিতি উত্তেজনাকর অবস্থায় রয়েছে।
‘একজন স্বৈরশাসক ও পুতিনের মিত্রের পতন’
পুতিন ও আসাদের সমালোচকেরা সিরীয় স্বৈরশাসকের পতনকে দ্রুতই উদ্যাপন করেছেন। আসাদ শাসনের সমাপ্তিকে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সম্ভাব্য অবসান হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
রাশিয়ার প্রবীণ বিরোধী রাজনীতিক ইলিয়া ইয়েশিন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘একজন স্বৈরশাসক ও পুতিনের মিত্রের পতন হয়েছে।’
ইউক্রেনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা বলেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে আসাদকে বাসের নিচে ছুড়ে ফেলেছেন পুতিন। তাঁর রসদে ঘাটতি পড়েছে। তিনি যেমনটা দেখাচ্ছেন, তেমনটা শক্তিশালী নন।’
তবে কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, রাশিয়া যতক্ষণ লাতাকিয়ায় তার ঘাঁটিগুলো ধরে রাখতে পারবে, ততক্ষণ তার সার্বিক নীতিগত উদ্দেশ্য ও আঞ্চলিক অবস্থান এবং সেই সঙ্গে নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষায় প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের পল সালেম বলেন, মধ্যপ্রাচ্য রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্বের সম্পর্ক, যেমন উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার জ্বালানি বাণিজ্য, বেসামরিক খাতে পারমাণবিক উপকরণ বিক্রি এবং ব্যয়বহুল ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্রমহ্রাসমান অস্ত্র বিক্রির মতো বিষয়গুলো বিভাজন সৃষ্টিকারী একজন মিত্রের পতনে সম্ভবত প্রভাবিত হবে না।
তাই, এ ক্ষতি (সিরিয়াকে হাতছাড়া করা) প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার জন্য খুব বেশি পরিবর্তন সৃষ্টিকারী হবে না, বলেন পল সালেম। এর কারণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্র দেশ ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার নিবিড় সম্পর্ক অটুট থাকার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
পল সালেম বলেন, সিরিয়া থেকে আসাদকে হারিয়ে ফেলা পুতিনের মানসম্মানের জন্য নিশ্চিতভাবেই এক ধাক্কা। তবে সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্যে পুতিনের যে অবস্থান, তাতে এটি বিরাট কোনো পরিবর্তন বয়ে আনবে না।