ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান সংঘাতটা এখনো ফিলিস্তিনের গাজাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার মতো দুঃস্বপ্নের রূপ তা এখনো নেয়নি। তবে কয়েক দিন ধরে এ অঞ্চলে যেসব ঘটনা ঘটেছে, ততে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আরও গুরুতর হয়ে উঠছে।
বিপদের মূলে রয়েছে লোহিত সাগর। এই জলপথ দিয়ে চলাচলকারী পণ্যবাহী বেশ কয়েকটি জাহাজে হামলা চালিয়েছেন ইয়েমেনের ইরানপন্থী হুতি বিদ্রোহীরা। জাহাজগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সংযোগ রয়েছে বলে বিশ্বাস তাদের। পরিস্থিতি সামলাতে একটি বহুজাতিক নৌজোট গড়ে তুলে এ অঞ্চলের জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে হুতিদের সঙ্গে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে জড়াতে নারাজ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁর আশঙ্কা—এমন পদক্ষেপে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
শিয়া মুসলিমদের একটি শাখা জাইদিজম। এই শাখার প্রতিনিধিত্ব করেন হুতিরা। একসময় গোষ্ঠীটি ইয়েমেন শাসন করত।
বাইডেনের ওই মনোভাবের পরও গত সপ্তাহের রোববার লোহিত সাগরে হুতিদের তিনটি নৌকায় হামলা চালিয়েছে মার্কিন নৌবাহিনী। ওই নৌকাগুলোর আরোহীরা একটি পণ্যবাহী জাহাজে হামলা চালাচ্ছিলেন। একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপস। তাঁর কথা, হুতিরা যদি হামলা চালিয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাজ্য আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না।
এদিকে হুতিদের সমর্থন না দিতে ইরানকে আহ্বান জানিয়েছিল ওয়াশিংটন ও লন্ডন। সে আহ্বান নাকচ করেছে তেহরান। আবার লোহিত সাগরে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে ইরান। এরই মধ্যে ইয়েমেনে সামরিক স্থাপনাগুলোয় হামলার বিষয়ে একটি সতর্কবার্তা জারি করার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এ দুই দেশের সঙ্গে ইউরোপের আরেকটি দেশ থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে।
তো দেখে নেওয়া যাক, লোহিত সাগর ঘিরে কী ঘটছে। আর আগামীতে কী ঘটবে—তা নিয়ে কেনইবা এত আশঙ্কা।
গত ৭ অক্টোবর ইসায়েলে হামলা চালায় হামাস। এর পরপরই হুতি নেতা আবদুল মালিক আল–হুতি হামাসের প্রতি তাঁর সমর্থন ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, তাঁর বাহিনীর ‘লাখ লাখ সদস্য ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যোগ দিতে এবং শত্রুর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে।’
আবদুল মালিক হয়তো বাড়িয়েই বলেছিলেন। কারণ, প্রথম দিকে হুতিরা শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়েই হামলা চালিয়েছিলেন। যেসব হামলার বেশির ভাগই ঠেকিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। তবে গত ১৯ নভেম্বর লোহিত সাগরে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে একটি জাহাজ দখলে নেন হুতি বিদ্রোহীরা। জাপান পরিচালিত ওই জাহাজের মালিক ছিলেন ইসরায়েলের এক ব্যবসায়ী। জাহাজটির ক্রু সদস্যদের অপহরণ করা হয়। হুতিরা বলেন, এই জলপথে ইসরায়েল–সংশ্লিষ্ট সব জাহাজে হামলা চালাবেন তাঁরা।
সাম্প্রতিক সময়ে লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে ১৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। হুতিদের বিশ্বাস, ইসরায়েল বা দেশটির মিত্রদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এ জাহাজগুলোর। তবে গত রোববারের আগ পর্যন্ত এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্র। রোববারই প্রথম লোহিত সাগরে তিনটি হুতি নৌকা লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে নৌকাগুলোয় থাকা ১০ হুতি বিদ্রোহী নিহত হন।
বলা হচ্ছে, ওই নৌকাগুলোয় থাকা হুতি বিদ্রোহীরা একটি পণ্যবাহী জাহাজে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের ঠেকাতেই মার্কিন বাহিনীর কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছিল জাহাজটি থেকে। এদিকে আবার ওয়াশিংটন বলেছে, নিজেদের রক্ষার জন্য নৌকাগুলোয় গুলি চালানো হয়েছিল। তবে যে যা–ই বলুক, ১০ বিদ্রোহীর মৃত্যু চলমান সংকটে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য লোহিত সাগরে জাহাজের নিরাপত্তাটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এশিয়া থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যের জন্য এই জলপথ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের ৩০ শতাংশ কনটেইনারবাহী জাহাজ এই অঞ্চল দিয়ে চলাচল করে। তাই এই জলপথের নিরাপত্তায় কোনো হুমকি জ্বালানি তেলের দামের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোতে এশিয়ায় উৎপাদিত পণ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। ইসরায়েলেরও বিপুল পরিমাণ পণ্য লোহিত সাগর দিয়ে আমদানি–রপ্তানি হয়। তাই এই জলপথের ওপর বড় নির্ভরশীলতা রয়েছে দেশটির।
লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান ফ্লেক্সপোর্টের দেওয়া তথ্য বলছে, লোহিত সাগর অঞ্চল দিয়ে চলাচলকারী কনটেইনারবাহী প্রায় অর্ধেক সংখ্যক জাহাজ এ অঞ্চল এড়িয়ে চলছে।
শিয়া মুসলিমদের একটি শাখা জাইদিজম। এই শাখার প্রতিনিধিত্ব করেন হুতিরা। একসময় গোষ্ঠীটি ইয়েমেন শাসন করত। তবে ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের সময় থেকে তারা দেশটিতে সুন্নি শাসনের অধীনে কোণঠাসা হয়েছে। ২০১৪ সালে হুতিরা এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটায়। এর জেরে ইয়েমেনে গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে অভিযান চালায় সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। ফলে আবার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। জাতিসংঘের হিসাবে ওই গৃহযুদ্ধে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ আনুমানিক ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভিটামাটি ছেড়েছেন ৪০ লাখ মানুষ।
হুতিরাই বস্তুত ওই যুদ্ধে জয় পেয়েছিল। ২০২২ সালের এপ্রিলে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর যুদ্ধে সহিসংতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছিল। গত বছরের অক্টোবরে চুক্তির মেয়াদ শেষে হলেও লড়াই বলতে গেলে তেমন আর হচ্ছে না। বর্তমানে বেশির ভাগ ইয়েমেনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোয় বসবাস করেন। দেশটির উত্তরের বেশির ভাগ অঞ্চল দখলে রেখেছেন হুতিরা। ইয়েমেনে লোহিত সাগরের উপকূলও তাদের নিয়ন্ত্রণে।
সৌদি আরবের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শত্রুতা ইরানের। মূলত এ কারণেই হুতিদের সমর্থন দিয়ে আসছে তেহরান। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ করা গোয়েন্দা তথ্যে জানানো হয়েছে, লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলায় সংশ্লিষ্টতা রয়েছে ইরানের। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এসব হামলার পর নিজ দেশে জনসমর্থন বেড়েছে হুতিদের। তাঁরা এটাও বিশ্বাস করেন যে লোহিত সাগরে হামলার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হুতিরা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন।
বর্তমানে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টায় রয়েছে সৌদি আরব। ইয়েমনের উত্তরে হুতিদের নিয়ন্ত্রণের স্বীকৃতি দিতে একটি শান্তি চুক্তি চূড়ান্ত করার চেষ্টাও চালাচ্ছে তারা। তবে রিয়াদের শঙ্কা, হুতিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নিলে ইয়েমেন থেকে সৌদি সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়াটা জটিল হয়ে পড়তে পারে।
চলমান সংকটের জেরে সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর দিয়ে পণ্য পরিবহন বন্ধ রেখেছে বিপি ও জার্মান প্রতিষ্ঠান হাপাগ–লয়েডসহ জলপথে পণ্য পরিবহনকারী সর্ববৃহৎ ১০টি প্রতিষ্ঠানের সাতটিই। এক সপ্তাহ আগেই লোহিত সাগর দিয়ে পণ্য পরিবহন শুরু করেছিল ডেনমার্কের প্রতিষ্ঠান মায়ের্স্ক। গত সপ্তাহে এ জলপথে জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার পর তা আবার স্থগিত করেছে তারা।
তবে যুক্তরাষ্ট্র নৌজোট গঠনের পর অনেক প্রতিষ্ঠান লোহিত সাগর দিয়েই পণ্য পরিবহন চালিয়ে যাচ্ছে। পণ্যবাহী অনেক জাহাজ আবার বিকল্প পথও ব্যবহার করছে। এমন অনেক জাহাজ এশিয়া থেকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে ইউরোপে যাচ্ছে। এতে সাধারণের চেয়ে দুই সপ্তাহ সময় বেশি লাগতে পারে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান ফ্লেক্সপোর্টের দেওয়া তথ্য বলছে, লোহিত সাগর অঞ্চল দিয়ে চলাচলকারী কনটেইনারবাহী প্রায় অর্ধেক সংখ্যক জাহাজ এ অঞ্চল এড়িয়ে চলছে। এতে পরিবহন খরচ বাড়ছে। প্রতিটি ৪০ ফুটের কনটেইনারের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার ডলারের মতো মাসুল দিতে হচ্ছে। ফলে সংকটের আগের সময়ের তুলনায় বর্তমানে পরিবহন খরচ তিন গুণ বাড়তে পারে।
লোহিত সাগরে হুতিদের হুমকি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে যে জাহাজগুলো বর্তমানে এ পথ এড়িয়ে চলছে, আগামীতেও তারা একই কাজ করবে। এমনকি অন্য অনেক জাহাজও এ তালিকায় নাম লেখাতে পারে। চলমান সংকটের জেরে এখনো বিশ্বে জ্বালানি তেলের দামের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি। তবে হুমকি যদি আবার বাড়তে থাকে এবং তা থেকে বের হওয়ার কোনো কৌশল না পাওয়া যায়, তাহলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে।
হুতিদেরও দমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি গোষ্ঠীটি বলেছে, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে অনুমতি এবং ইসরায়েলের হামলা বন্ধ করা ছাড়া তারা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা বন্ধ করবে না। তাদের ওই হিসাবনিকাশে বদল না এলে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত ইয়েমেনে বিভিন্ন হুতি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এতে তেহরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উত্তেজনা বাড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে আরও বড় পরিসরে মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে এ দুই দেশ, যা এড়াতে চাইছেন বাইডেন।