লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে গত শুক্রবার আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা চালিয়ে তিনজন গণমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এ ঘটনা ইসরায়েলের অন্যায়ের দায়মুক্তি অবসানের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
সোচ্চার মানুষেরা বলছেন, বিস্তৃত যুদ্ধ-সংঘাতে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে একের পর এক সাংবাদিক আর গণমাধ্যমকর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনা ও ইসরায়েলের জবাবদিহি না করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার নজির, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের। কেননা দেশটি ইসরায়েলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বেশ উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের প্রতি আহ্বান জানানো উচিত, যাদের ইসরায়েলি সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনা এবং এ সহিংসতা বন্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে।রেবেকা ভিনসেন্ট, আরএসএফের প্রচারণা পরিচালক।
লেবাননে হামলা চালিয়ে তিনজন গণমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করার দিন কয়েক আগে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ‘ভিত্তিহীন’ভাবে আল-জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর (হামাস) সদস্য হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। এর ফলে এসব সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) প্রচারণা পরিচালক রেবেকা ভিনসেন্ট বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বেশ উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের প্রতি আহ্বান জানানো উচিত, যাদের ইসরায়েলি সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনা এবং এ সহিংসতা বন্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে।’
গত শুক্রবার লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর হাসবিয়াতে এমন একটি আবাসিক চত্বরে বিমান হামলা চালানো হয়, যেখানে কয়েকজন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী অবস্থান করছিলেন। এলাকাটি সংঘাতের আওতামুক্ত ছিল। এমনকি হামলা চালানোর আগে সতর্ক করে দেওয়া হয়নি। হামলায় কয়েকটি আবাসিক ভবন ও ‘সংবাদমাধ্যম’ লেখা গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা ধ্বংস হতে দেখা গেছে।
হামলার বিষয়ে লেবাননের তথ্যমন্ত্রী জিয়াদ মাকারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে বলেন, এটা এমন একটি হামলা, যা যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও খুঁজে পেতে চিন্তাভাবনা করেই চালানো হয়েছে। এ জায়গায় সাতটি সংবাদমাধ্যমের ১৮ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী অবস্থান করছিলেন।
লেবানন ও ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিম তীরে গত এক বছরে অন্তত ১২৮ জন সাংবাদিক-গণমাধ্যমকর্মী ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। চার দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিক হত্যা আর গণমাধ্যমের ওপর অত্যাচারের তথ্য সংগ্রহ করছে নিউইয়র্কভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। সংগঠনের মতে, তাদের তথ্য সংগ্রহের পর থেকে এখন সবচেয়ে ‘প্রাণঘাতী সময়’ পার করছে সংবাদমাধ্যম।
লেবাননে হামলা চালিয়ে তিনজন গণমাধ্যমকর্মীকে হত্যা করার দিন কয়েক আগে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ‘ভিত্তিহীন’ভাবে আল-জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর (হামাস) সদস্য হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। এর ফলে এসব সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
তবে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, হত্যার শিকার সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যা আরও বেশি। শুধু গাজায় এ সংখ্যা ১৭৬–এর বেশি।
আল–জাজিরাকে পাঠানো এক বিবৃতিতে সিপিজের প্রোগ্রাম পরিচালক কার্লোস মার্তিনেজ দে লা সেরনা বলেন, ‘সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর আরেকটি প্রাণঘাতী ইসরায়েলি হামলায় সিপিজে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ। এবার দক্ষিণ লেবাননে একটি ভবনে হামলা করা হয়েছে, যেখানে ১৮ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী অবস্থান করছিলেন।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু বানানো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ। এই হামলার স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে এবং দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
গাজায় নিহত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিনিয়ত অপবাদ দিয়ে আসছে ইসরায়েল। তাদের অভিযোগ, নিহত ব্যক্তিরা গাজার হামাস কিংবা অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের সদস্য ছিলেন। যদিও এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি ইসরায়েল।
ইসরায়েল চায় না যে গাজায় কী ঘটছে, তা বিশ্ববাসী দেখুক।ডায়ানা বাট্টু, ফিলিস্তিনি আইনজীবী ও বিশ্লেষক।
এই সপ্তাহে আল-জাজিরার ছয়জন সাংবাদিককে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইসরায়েল। তাই উদ্বেগ ছড়িয়েছে, এসব সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হতে পারে বলে তাঁদের এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও আল-জাজিরার পক্ষ থেকে ইসরায়েলি অভিযোগ স্পষ্টত প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় আল-জাজিরার কয়েকজন সাংবাদিক-গণমাধ্যমকর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে ইসরায়েল। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে গাজা উপত্যকায় আল-জাজিরার প্রতিনিধি ইসমাইল আল-গৌল এবং ক্যামেরাম্যান সামের আবুদাকা রয়েছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অবরুদ্ধ ও যুদ্ধকবলিত গাজা উপত্যকায় বিদেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। সমালোচকেরা বলছেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ‘যুদ্ধাপরাধের’ তথ্য গোপন রাখতেই ইসরায়েল এমনটা করেছে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের হত্যা করা এবং প্রমাণ না থাকলেও তাঁদের ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়ার ইসরায়েলি প্রবণতা নিয়ে সিপিজে বারবার তথ্য–প্রমাণ দিচ্ছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিকদের ওপর সর্বশেষ হুমকি এসেছে এমন একসময়ে, যখন গাজা উপত্যকায় বিদেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ করতে দিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। এ বছরের শুরুর দিকে ৭০টির বেশি সংবাদমাধ্যম ও অধিকার সংগঠন এই দাবি জানিয়ে ইসরায়েল সরকারের প্রতি একটি খোলাচিঠি লিখেছিল। সম্প্রতি ডজনখানেক মার্কিন আইনপ্রণেতার কণ্ঠেও একটি আহ্বান শোনা গেছে।
ফিলিস্তিনি আইনজীবী ও বিশ্লেষক ডায়ানা বাট্টু বলেন, ‘ইসরায়েল চায় না যে গাজায় কী ঘটছে, তা বিশ্ববাসী দেখুক।’
আল-জাজিরাকে ডায়ানা বাট্টু বলেন, একদিকে তারা (ইসরায়েল) বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় ঢুকতে দিচ্ছে না। অন্যদিকে তারা সেখানে থাকা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করছে। এর পাশাপাশি গাজায় কর্মরত সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর জন্য বিভিন্ন তকমা দেওয়া হচ্ছে।
ডায়ানা বাট্টুর মতে, হামাস ও হিজবুল্লাহর সদস্য হিসেবে তকমা দিয়ে হত্যাকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান কার্নেগি এনডওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেলো জাহা হাসান বলেন, এখন সাংবাদিকদের জন্য কাজ করার সবচেয়ে মারাত্মক জায়গা হলো যেখানে ইসরাইল যুদ্ধ চালাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি এ বছরের শুরুতে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। তাতে গাজায় ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের জীবনযাপন ও কাজ করার দৃশ্যায়ন ছিল। ভিডিওটিতে সাংবাদিক সামি শেহহাদেহর কথাও ছিল। ভিডিওটি প্রকাশের আগে আগে সুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলায় পা হারান সামি। কাজের সূত্রে সেখানে ছিলেন তিনি।
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ইসরায়েলি হামলার লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ কার্যত সফল হয়নি। বিশ্লেষকেরা সমালোচনা করে বলেন, গণমাধ্যমের ওপর একের পর এক ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে মনোযোগ দিতে ও ক্ষোভ ঝাড়তে মূলধারার বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলো পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখছে না।
জাহা হাসান বলেন, ২০২২ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীরে আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী। শিরিন মার্কিন নাগরিক ছিলেন। এরপরও তাঁর হত্যার জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়নি।
শিরিনকে হত্যা করার কয়েক মাস পর মার্কিন আইনপ্রণেতা ও আইনজীবীরা এ হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানান। মার্কিন ও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ এ হত্যা নিয়ে একটি তদন্ত শুরু করেছে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে কখনোই প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। কিছু প্রকাশ করা হয়নি। কাউকে শাস্তিও দেওয়া হয়নি।
জাহা হাসান বলেন, ‘যদি নিজের সরকারের দ্বারাই শিরিনের হত্যার বিচার অস্বীকার করা হয়, তাহলে আমরা কীভাবে লেবানন ও ফিলিস্তিনে কাজ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হওয়া সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য বিচার পাওয়ার আশা করতে পারি?’
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ইসরায়েলি হামলার লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ কার্যত সফল হয়নি। বিশ্লেষকেরা সমালোচনা করে বলেন, গণমাধ্যমের ওপর একের পর এক ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে মনোযোগ দিতে ও ক্ষোভ ঝাড়তে মূলধারার বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলো পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখছে না।
শিরিন আবু আকলেহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডায়ানা বাট্টু বলেন, ‘এই ফিলিস্তিনি সাংবাদিকেরা, এই লেবাননের সাংবাদিকেরা, তাঁদের জীবন আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের চেয়ে কম যোগ্য নয়। কিন্তু আমরা কোনো ধরনের ক্ষোভ দেখিনি। এটা অবিশ্বাস্য।’
এর চেয়ে বরং বিকল্প কিছু সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিয়ে সরব রয়েছে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ইসরায়েলি হামলার সমালোচনা করেছে। এ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রগতিশীল সংবাদমাধ্যম ‘জিউস কারেন্ট’ আল-জাজিরার ওই ছয় সাংবাদিকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে।