একটি সামরিক মহড়ায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা
একটি সামরিক মহড়ায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা

হিজবুল্লাহর ভান্ডারে যেসব অস্ত্র আছে

৯ মাসের বেশি সময় ধরে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমিক আন্তসীমান্ত সংঘাত চলছে। এই সময়ে ইসরায়েলে হামলা চালাতে নানা অস্ত্র ব্যবহার করেছে হিজবুল্লাহ।

বিশ্বের অন্যতম অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ভান্ডারে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আছে। বলা হয়ে থাকে, অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হিজবুল্লাহর কাছেই সবচেয়ে বেশি অস্ত্রের মজুত আছে।

হিজবুল্লাহর দাবি, সংগঠনটির ভান্ডারে যে অস্ত্রশস্ত্র আছে, তার খুব সামান্যই তারা এ পর্যন্ত ব্যবহার করেছে।

অস্ত্রের ভান্ডার

মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক অনুযায়ী, ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কাছে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট আছে।

হিজবুল্লাহ বলছে, সংগঠনটির কাছে এমন রকেট আছে, যা ইসরায়েলের সর্বত্র আঘাত আনতে সক্ষম। এ ছাড়া হিজবুল্লাহর কাছে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যেগুলো নির্ভুলভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম। আছে ড্রোন, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও জাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র।

হিজবুল্লাহর প্রধান সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারী আঞ্চলিক শক্তি ইরান। গোষ্ঠীটির অনেক অস্ত্র ইরান, রাশিয়া ও চীনা মডেলের।

হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ ২০২১ সালে বলেছিলেন, তাঁর সংগঠনের এক লাখ যোদ্ধা আছে।

অবশ্য সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক বলছে, ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর প্রায় ৪৫ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার সার্বক্ষণিক যোদ্ধা হিসেবে নিয়োজিত।

স্থল হামলার রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র

হিজবুল্লাহর কাছে আনগাইডেড মিসাইল ও রকেট আছে। ২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সবশেষ যুদ্ধ হয়েছিল হিজবুল্লাহর। সে সময় ইসরায়েল লক্ষ্য করে হিজবুল্লাহ প্রায় ৪ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল কাতিউশা মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্র ৩০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।

হিজবুল্লাহর প্রধানের দাবি, ২০০৬ সালের পর সংগঠনের অস্ত্রের ভান্ডারে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। নির্ভুলভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর প্রযুক্তি তারা সম্প্রসারণ করেছে। এমনকি লেবাননে বসেই এ প্রযুক্তি যুক্ত করার সক্ষমতা আছে গোষ্ঠীটির।

রাদ, ফজর, জিলজালসহ ইরানি মডেলের নানান রকেট আছে হিজবুল্লাহর কাছে। এগুলো কাতিউশার চেয়ে বেশি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। অপেক্ষাকৃত বেশি দূরত্বে আঘাত হানতে পারে।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজা যুদ্ধ চলাকালে হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইসরায়েলে অনেক রকেট ছুড়েছে হিজবুল্লাহ। এর মধ্যে ছিল কাতিউশা মডেলের রকেট। এ ছাড়া ছিল বুরকানের মডেলের ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলো ৩০০ থেকে ৫০০ কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক বহন করতে পারে।

গত জুন মাসে প্রথমবারের মতো ইরানের তৈরি ফালাক-২ রকেট ব্যবহার করে হিজবুল্লাহ। আগে ব্যবহার করা ফালাক-১-এর তুলনায় ফালাক-২ বড় বিস্ফোরকমুখ (ওয়ারহেড) বহন করতে পারে।

ট্যাংক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র

২০০৬ সালের যুদ্ধে গাইডেড ট্যাংক–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিল হিজবুল্লাহ। তারা এখন আবার এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার তৈরি করনেট ক্ষেপণাস্ত্রও মোতায়েন করেছে হিজবুল্লাহ।

ইরানপন্থী আরবি ভাষার একটি সম্প্রচারমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিজবুল্লাহ ইরানের তৈরি আল-মাস ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে।

ইসরায়েলের আলমা রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আল-মাস দৃষ্টিসীমার বাইরের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। এটি ওপর থেকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।

যুদ্ধবিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র

চলমান সংঘাতে অনেকবার ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের এসব ড্রোনের মধ্যে আছে হারমেস ৪৫০ ও হারমেস ৯০০। এই ড্রোন ধ্বংস করতে হিজবুল্লাহ ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে।

হিজবুল্লাহর কাছে যুদ্ধবিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র আছে বলে অনেক আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। তবে এবারই প্রথম হামলায় এই ক্ষেপণাস্ত্র হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করতে দেখা গেল।

অন্যদিকে এবারই প্রথম হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে অস্ত্র ছুড়েছে। এর ফলে লেবাননের আকাশসীমা ছাড়তে বাধ্য হয় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান।

তবে এ ক্ষেত্রে হিজবুল্লাহ কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তা জানায়নি সংগঠনটি। হিজবুল্লাহ অস্ত্র ছুড়লেও তা অবশ্য ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানে আঘাত করতে পারেনি।

ড্রোন

হিজবুল্লাহ ড্রোন ব্যবহার করে ইসরায়েলে অনেক হামলা চালিয়েছে। বিস্ফোরকভর্তি এসব ড্রোন ছিল একমুখী। এই ড্রোনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়।

অবশ্য গোষ্ঠীটি এ কথাও বলছে যে তারা এমন সব ড্রোন ব্যবহার করছে, যেগুলো লক্ষ্যবস্তুতে বোমা নিক্ষেপ করে আবার লেবাননে ফিরে আসতে সক্ষম।

কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করার জন্য হিজবুল্লাহ ড্রোন পাঠিয়েছে। আর এ সুযোগে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য তারা কিছু ড্রোন পাঠিয়েছে।

হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারে আছে স্থানীয়ভাবে সংযোজন করা আইয়ুব ও মেরসাদ মডেলের ড্রোন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব ড্রোন তৈরি করা অপেক্ষাকৃত সহজ ও সাশ্রয়ী।

জাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র

হিজবুল্লাহ ২০০৬ সালে প্রথম প্রমাণ করে, তাদের কাছে জাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র আছে। সে সময় উপকূল থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে ইসরায়েলি একটি যুদ্ধজাহাজে আঘাত করে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র। এতে চার ইসরায়েলি নিহত হয়। জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০০৬ সালের যুদ্ধের পর হিজবুল্লাহ নিজেদের অস্ত্রাগারে রাশিয়ার তৈরি ইয়াখন্ত নামের জাহাজ–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করে বলে জানায় সূত্র। এ ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। তবে এই অস্ত্র থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেনি হিজবুল্লাহ।