গাজায় গণহত্যা ও ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা বন্ধের দাবিতে প্রতীকী লাশ সেজে প্রতিবাদী বিক্ষোভ। গত শনিবার মাল্টার ঘাদিরায়
গাজায় গণহত্যা ও ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা বন্ধের দাবিতে প্রতীকী লাশ সেজে প্রতিবাদী বিক্ষোভ। গত শনিবার মাল্টার ঘাদিরায়

এবার রাফায় স্থল অভিযানের হুমকি

ফিলিস্তিনের গাজার একেবারে দক্ষিণের রাফা এলাকায় বিমান হামলার পাশাপাশি সেনা পাঠিয়ে হামলা চালাবে ইসরায়েল। গাজার অর্ধেক বাসিন্দা মিসর সীমান্তবর্তী এই এলাকায় ঠাঁই নিয়েছেন।

গত শুক্রবার থেকে রাফায় ব্যাপক বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত তিন দিনে বড় পরিসরে এ হামলার জেরে সেখানে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে স্থল অভিযানের হুমকি এল।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শরণার্থী অধিকার বিশেষজ্ঞ নাদিয়া হারদ্‌মান বলেন, ‘ইসরায়েল যে গাজার বড় অংশ বসবাসের অনুপযোগী করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, এমন অসংখ্য প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পুরো গাজার মানুষকে এক জায়গায় করে এরপর অভিযান চালানো। এটা যুদ্ধাপরাধ।’

জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলা শুরুর আগে রাফায় দুই লাখ ফিলিস্তিনি বাস করতেন। কিন্তু বর্তমানে উপত্যাকাটির ২৩ লাখ বাসিন্দার অর্ধেক বাড়িঘর ছেড়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

রাফায় ইসরায়েলি সেনাদের অভিযান মিসরের জন্যও একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে এ নিয়ে কায়রো সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ইসরায়েলি হামলার মুখে ফিলিস্তিনি শরণার্থীর ঢল নামতে পারে। কিন্তু তারা ফিলিস্তিনিদের সীমান্ত পার হয়ে দেশে ঢুকতে দেবে না।

ইসরায়েল যে গাজার বড় অংশ বসবাসের অনুপযোগী করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, এমন অসংখ্য প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পুরো গাজার মানুষকে এক জায়গায় করে এরপর অভিযান চালানো। এটা যুদ্ধাপরাধ।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শরণার্থী অধিকার বিশেষজ্ঞ নাদিয়া হারদ্‌মান

তবে ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরু হলে রাফা থেকে এসব ফিলিস্তিনি যাতে মিসরে না ঢুকে গাজার উত্তর অংশের দিকে যেতে পারেন, এর উপায় খুঁজে বের করতে মিসরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।

গত সপ্তাহে ইসরায়েল জানায়, তাদের মূল মনোযোগ এখন রাফা। এরপরই রাফায় বড় পরিসরে বিমান হামলা শুরু হয়। গতকাল রোববারও রাফায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলায় বেশ কিছু বাড়িঘর ধসে গেছে। গতকাল রাফায় একটি কিন্ডারগার্টেনে হামলায় দুই শিশু শিক্ষার্থী নিহত হয়।

মোহাম্মদ কালৌব নামে নিহত দুই শিশুর এক স্বজন রয়টার্সকে জানান, গতকাল ইসরায়েলি বিমান থেকে ফেলা বোমা তাদের বাড়ির একটি কক্ষে এসে পড়ে। কক্ষটি ছিল নারী–শিশুতে পূর্ণ। মোহাম্মদ কালৌব এ সময় বলেন, ‘উত্তর থেকে দক্ষিণ গাজার কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই।’

ইসরায়েলের দাবি, খান ইউনিসে হামাস যোদ্ধাদের একটি ইউনিট ছাড়া সব ইউনিটকে নির্মূল করেছে তারা। খান ইউনিসে কয়েক সপ্তাহ টানা ব্যাপক হামলা ও স্থল অভিযান চালানোর পরই এমন দাবি করে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকাটির উত্তর অংশে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে বেশি। উত্তরের পর দক্ষিণে অগ্রসর হতে শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণের প্রধান শহর খান ইউনিসে ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল।

ইসরায়েলের দাবি, খান ইউনিসে হামাস যোদ্ধাদের একটি ইউনিট ছাড়া সব ইউনিটকে নির্মূল করেছে তারা। খান ইউনিসে কয়েক সপ্তাহ টানা ব্যাপক হামলা ও স্থল অভিযান চালানোর পরই এমন দাবি করে ইসরায়েল। এরপর আরও দক্ষিণে রাফায় হামলা চালানোর হুমকি দেয় তারা।

এক্সে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, গতকালও জল, স্থল ও আকাশপথে গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে তারা।

রাতভর গাজাজুড়ে হামলা

গত শনিবারও রাতভর গাজাজুড়ে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। খান ইউনিস ও গাজা নগরসহ বিভিন্ন শহর ও এলাকায় বিমান হামলার পাশাপাশি গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি সেনারা। কিছু কিছু জায়গায় ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে হামাস যোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণলায় গতকাল জানায়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় আরও অন্তত ১২৭ জন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গত চার মাসে গাজায় অন্তত ২৭ হাজার ৩৬৫ ফিলিস্তিনি নিহত হলেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৬৬ হাজার ৬৩০ জন।

এদিকে এক্সে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, গতকালও জল, স্থল ও আকাশপথে গাজার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে তারা।

‘যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত সময়সাপেক্ষ’

ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলার মুখে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে কাতার ও মিসর। এতে যুক্তরাষ্ট্রও মধ্যস্থতাও করছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বিবদমান পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকের পর মধ্যস্থতাকারীরা বলেছিল, তারা যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে আশাবাদী। তবে হামাস জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সময় প্রয়োজন তাদের।

গত শনিবার লেবাননে এক সংবাদ সম্মেলনের হামাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওসামা হামদান বলেন, গাজায় সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। ইসরায়েল, কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের প্রস্তাবিত চুক্তিকাঠামোটি পর্যালোচনা করছেন হামাস নেতারা। তবে এ বিষয়ে হামাসের অবস্থান ঘোষণার জন্য আরও সময় দরকার বলে জানান হামদান।

প্যারিসে মধ্যস্থতাকারীদের তৈরি খসড়া প্রস্তাব প্রসঙ্গে হামদান বলেন, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা এখনো হয়নি। প্রস্তাবটিতে কিছু ঘাটতি আছে।

হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, তিন পর্যায়ের বর্তমান প্রস্তাবটিতে প্রাথমিকভাবে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির বিষয়টি রয়েছে। যুদ্ধবিরতির মেয়াদ পরে বাড়তে পারে।

এদিকে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল বলেছেন, ‘আমরা সব ধরনের প্রস্তাবে ও কোনো মূল্য দিয়ে (যুদ্ধবিরতির) প্রস্তাবে রাজি হব না।’

এর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছিল, কিছু ক্ষেত্রে তাদের আপত্তি আছে। এসব নিয়ে মধ্যস্থতাকারীরা আলোচনা চালাবে।

এদিকে ফ্রান্সের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্তেফান সোজোর্নে মিসর সফরে গেছেন। প্রথম মধ্যপ্রাচ্য সফরে জর্ডান, ইসরায়েল ও লেবানন যাবেন তিনি। ফ্রান্স জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়ে এসব দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন স্তেফান সোজোর্নে।