গাজায় ভাসমান বন্দর নির্মাণ করা হলে সেটি দেখতে হবে এ রকম
গাজায় ভাসমান বন্দর নির্মাণ করা হলে সেটি দেখতে হবে এ রকম

ফিলিস্তিনে ভাসমান বন্দর চালানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা জটিল হবে

ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য গাজা উপকূলে একটি ভাসমান বন্দর নির্মাণ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভূমধ্যসাগরে অস্থায়ী এই বন্দর নির্মাণ করতে নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে।

ভাসমান এই বন্দর নির্মাণে এক হাজারের বেশি মার্কিন সেনা কাজ করবে বলে জানা যাচ্ছে। তবে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছে, এসব মার্কিন সেনা সমুদ্রেই কাজ করবে। তাদের কারও পা গাজার মাটিতে পড়বে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি এতটা সহজ নয়।

অখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ভাসমান এই বন্দর ব্যবস্থাপনার কাজটি করবে মার্কিন সামরিক বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ফগবো। প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দুজন সাবেক কর্মকর্তা।

ভাসমান এই বন্দর (মূলত জেটি) নির্মাণের লক্ষ্য গাজায় প্রতিদিন ২০ লাখ মানুষের খাবার পৌঁছানো। জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করে বলে আসছে, পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে অব্যাহত ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। গাজার বাসিন্দাদের অনেকে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে খাদ্যাভাবে অনেকের মৃত্যু হতে পারে।

ভাসমান বন্দর নির্মাণ হবে কীভাবে

কয়েকটি জাহাজে করে ভাসমান জেটি নির্মাণের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আগামী শনি ও সোমবার গাজা উপকূলে যাওয়ার কথা মার্কিন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের। পেন্টাগন জানিয়েছে, বন্দর নির্মাণে দুটি মূল জিনিসের প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে একটি ভাসমান ডক, যা ইস্পাতের তৈরি। অন্যটি মূলত ১ হাজার ৮০০ ফুট দৈর্ঘ্যের দুটি সংযোগ সড়ক। সেতুর মতো দেখতে এই পথ দিয়েই জেটি থেকে সৈকত পেরিয়ে গাজায় নেওয়া হবে বন্দরে আসা ত্রাণসামগ্রী।

খাবারের তীব্র সংকটে গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি চলছে। অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকছেন

পণ্যবাহী জাহাজ ত্রাণসামগ্রী ডকে পৌঁছে দেবে। এরপর সেগুলো ছোট ছোট নৌকা ও জাহাজে করে নেওয়া হবে ভাসমান বন্দরে। এরপর সেখান থেকে যানবাহনে করে ত্রাণসামগ্রী যাবে গাজায়। পেন্টাগন বলছে, সংযোগ সড়ক দুটি থাকায় মার্কিন সেনাদের জেটি থেকে গাজায় যাওয়ার দরকার পড়বে না।

এ ধরনের বন্দর জয়েন্ট লজিস্টিকস ওভার দ্য শোর (জেএলওটিএস) নামে পরিচিত। তবে মার্কিন বাহিনী প্রথমবার এমন বন্দর নির্মাণ করছে না। এর আগে কুয়েত, সোমালিয়া, হাইতি ও মধ্য আমেরিকায় দুর্যোগকালে ত্রাণসহায়তা পাঠাতে এমন বন্দর নির্মাণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

এ ধরনের বন্দর নির্মাণে অভিজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কোরের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মার্ক ক্যানসিয়ানের বলেন, এসব ক্ষেত্রে সচল বন্দরকেই অবশ্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কারণ, সচল বন্দর থাকলে সবকিছু অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু সব সময় সেটা পাওয়া যায় না। আর এমন ক্ষেত্রে মূলত জেএলওটিএস নির্মাণের বিষয়টি সামনে আসে।

ফগবো কারা, কী করবে তারা

ভাসমান এই বন্দরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সহযোগী ফগবোর নেতৃত্বে আছেন স্যাম মান্ডি ও মাইক মালরয়। স্যাম মান্ডি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন কোরের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। আর মাইক মালরয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) আধা সামরিক কর্মকর্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন।

বন্দর ব্যবস্থাপনায় ফগবোর কাজ কী হবে, তা আগে জানা না গেলেও বিষয়টি সম্পর্কে জানেন এমন একজন ব্যক্তি এ নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, গাজা উপকূলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর পর মূলত সেগুলো খালাস করার বিষয়টি ব্যবস্থাপনা করবে ফগবো।

ভাসমান এই বন্দরের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত একটি পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সরকার। অনুমোদিত সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, মার্কিন সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ভাসমান জেটিতে কনটেইনারে করে ত্রাণসামগ্রী যাবে। এরপর ত্রাণসামগ্রী কনেটেইনার থেকে খালাস করার কাজটি করবে ফগবো। তবে ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর কাজে প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত থাকবে না।

ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয় চলছে

বন্দরের নিরাপত্তা দেবে কারা

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাসমান এই বন্দরের সাফল্য নির্ভর করছে মূলত নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর। তাঁদের মতে, গাজায় এখনো সশস্ত্র লড়াই চলছে। এদিকে উপকূলে সাধারণ মানুষের সমাগম থাকে সব সময়। এসব কারণে অস্থায়ী বন্দরটির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রিয়ার অ্যাডমিরাল মার্ক মন্টোগোমারি বিবিসিকে বলেন, বন্দরটির কার্যক্রম চালাতে হলে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে হবে। নিরাপত্তা বলয়টি হবে সৈকত ও এর আশপাশে সমুদ্রের অগভীর এলাকা নিয়ে।

মার্ক মন্টোগোমারি বলেন, বন্দরের আশপাশে সাধারণ লোকজনের চলাচল বন্ধ করতে হবে। এসব লোকজন হতে পারেন এমন কোনো পিতা-মাতা, যাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাড়ের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। অথবা সেখানে কাউকে হত্যার চেষ্টা হতে পারে। এসব হলে নিরাপত্তাসংক্রান্ত কারণে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানেন এমন দুজন বিবিসিকে বলেন, সাধারণ কোনো লোকজন যাতে সৈকতে যেতে না পারে, সে জন্য এর আশপাশে পাহারা দেওয়ার কাজটি করবে ইসরায়েলির সামরিক বাহিনী। একই সঙ্গে বন্দর ও আশপাশের এলাকা নিরাপদ রাখার কাজটি করবে তারা।

এই দুই ব্যক্তি বলেন, বন্দর থেকে খালাস হওয়ার পর ত্রাণসামগ্রী এমন কিছু স্থানীয় ফিলিস্তিনির মাধ্যমে বণ্টন করার কাজটি করা হবে, যাঁরা হবেন নিরস্ত্র।

পেন্টাগন বলছে, বন্দরের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ফগবোর ভূমিকা হবে সীমিত। আর ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রমে জড়িত থাকবে না প্রতিষ্ঠানটি। বন্দর পরিচালনা ও ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর কাজে নিয়োজিত কোনো মার্কিন সেনার পা গাজার মাটিতে পড়বে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের মতে, পেন্টাগন যত সহজে এ কথা বলছে, বাস্তব ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটি হয়তো হবে আরও বেশি জটিল।