ভূমিকম্পের সময় সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আল-দানা শহরের একটি হাসপাতালে ছয় বছর বয়সী ছেলে মুস্তফার চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন সাংবাদিক ইসমাঈল আলরিজ। একটু পরপরই তীব্র কম্পনে হাসপাতাল ভবনটি ধসে পড়তে শুরু করে। ভবন থেকে ছেলেকে নিয়ে বেঁচে বের হতে পারলেও আটকে পড়ে রোগীসহ অসংখ্য মানুষ। বিবিসিকে হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস মেসেজে এই ভবন ধসের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন ইসমাঈল।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা ৭ হাজার ৮০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৮৯৪ জনের। আর সিরিয়ায় মারা গেছে ১ হাজার ৯৩২ জন। হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় সিরিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
গত সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানে শক্তিশালী ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এর পর থেকে দফায় দফায় আরও কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে দুই দেশে ধসে পড়েছে হাজার হাজার ভবন। এসব ভবনের নিচে আটকে পড়েছে বহু মানুষ। তাদের উদ্ধারে চেষ্টা করে যাচ্ছেন উদ্ধারকারী ও সাধারণ মানুষ। তবে উদ্ধারকাজে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তীব্র ঠান্ডা, তুষারপাত ও বৃষ্টি।
ইসমাঈল বলেন, ‘ভূমিকম্প আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। এরপর হাসপাতালের কাচের তৈরি প্রবেশদ্বার ভেঙে যেতে শুরু করল। এটা ছিল ভয়ংকর এক দৃশ্য। শুধু কল্পনা করছিলাম, এই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে কীভাবে আমার সন্তানকে উদ্ধার করব।’
এই ঘটনার এক মিনিট পরই অন্ধকারের মধ্যেই মুস্তফা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ইসমাঈলের দিকে ছুটে আসে। ভয়ে হাতের ক্যানোলা খুলে ফেলে। এ সময় তার হাত থেকে রক্ত বের হতে থাকে। তিনি কেবল নিজের ছেলে মুস্তফাকেই নয়, অন্ধকারে হাসপাতালে ভেতর হাতের কাছে যাকেই পেয়েছেন, তাঁকেই বের হতে সহায়তা করেছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেওয়ার আগে তিনি গাড়িতে একজন নার্স ও এক অন্তঃসত্ত্বাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তবে ইসমাঈলের স্ত্রী ও অন্য সন্তান বাড়িতে নিরাপদেই ছিল। তাঁদের বাড়ি ঠিকঠাক আছে।
ভূমিকম্পে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আল-দানা শহরের অবস্থা খুবই খারাপ। ইসমাঈল সেখানে দুটি আবাসিক ভবন ধসে পড়া দেখেছেন। বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উদ্ধারকারী দলকে খবর দেওয়া যায়নি। ইসমাঈল সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে কোনো উদ্ধারকারী দলকে তিনি সেখানে যেতে দেখেননি।
আল-দানা তুরস্কের সীমান্তবর্তী ইদলিব প্রদেশের বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহর। সিভিল ডিফেন্স ইউনিট সেখানে একমাত্র জরুরি সেবাদানকারী। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানো অসম্ভব।
ইসমাঈল বলেন, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি অবর্ণনীয়। যেসব এলাকায় আগে সরকার বা রাশিয়ান বাহিনী দ্বারা বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল, সেসব এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০১১ সালে সিরিয়ায় অভ্যুত্থানের কারণে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সিরিয়ার সরকার রাশিয়া সমর্থনে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় হামলা চালাতে থাকে। তবে তিন বছর ধরে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় কিছুটা যুদ্ধবিরতি চলছে।
ইসমাঈল বলেন, তিনি সরকার–নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো শহরের উত্তরে আতারেব শহরে কয়েক ডজন আবাসিক ভবন ধসে পড়া দেখেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ভবন ও আশপাশের এলাকায় সরঞ্জামের অভাবে উদ্ধারকারী দলগুলো পৌঁছাতে পারছে না। সত্যিই আমাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা দরকার।’
ভূমিকম্পের পর সিরিয়ান আমেরিকান মেডিকেল সোসাইটি (স্যামস) নামের একটি সংগঠন কাজ শুরু করে দিয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালগুলোর জন্য কাজ করে এই সংগঠন।
আতারেব শহরে স্যামস হাসপাতালে কাজের জন্য ডাকা হয়েছিল চিকিৎসক ওসামা সাল্লুমকে। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের প্রথম কয়েক মুহূর্তে কী ঘটছে, তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না।
‘খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে অনুভব করেছি। আমি কেবল ভবন ও পাথর ভেঙে পড়ার শব্দ শুনছিলাম’, বলছিলেন ওসামা। এই চিকিৎসক আরও বলেন, তিনি যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন সেখানে প্রায় ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর এই সাক্ষাৎকার দিতে দিতে সেই সংখ্যা ১২০ ছাড়িয়ে গেছে। আহত এত মানুষ যে সেই সংখ্যা তিনি গুণতে পারেননি।
ভূমিকম্প দেশটির উত্তরাঞ্চলে সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাতেও আঘাত হেনেছে। আয়া নামের একজন তাঁর পরিবারের সঙ্গে উপকূলীয় শহর লাতাকিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ঠিক সে সময় ভূমিকম্প আঘাত হানে। আয়ার মা পারকিনসনসের রোগী। তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন।
আয়া বলেছেন, ‘আমি হতবাক হয়েছিলাম, নড়তে পারছিলাম না। দেয়ালগুলো কীভাবে কাঁপছে আর পেছন সরে যাচ্ছে, তা আমি দেখতে থাকলাম। পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ ছিল, তা বর্ণনা করতে পারব না।’
২৬ বছর বয়সী শেফের বাড়ি সড়কের ওপর। বাড়িটির সব জানালাই কাচে ঘেরা। তিনি তাঁর মা ও তিন ভাই–বোনের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলেন। এ সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়।
শেফ বলেন, ‘আমি বিছানা থেকে উঠেছিলাম ঠিকই কিন্তু কী কারণে ঘুম ভেঙে গেল, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। পরিবারের অন্য সদস্যদের খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কী ঘটছে, তা বুঝতে পারছিলাম না। তীব্র ভূমিকম্পের কারণে আমরা নড়াচড়া করতে পারিনি।’