১২ হাজারের বেশি প্রাণহানি।
৪৫ শতাংশ বাড়িঘর ধসে পড়েছে।
৫১ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।
দরিদ্র বাড়তে পারে ৪৫ শতাংশ।
জল, স্থল ও আকাশপথে ৪০ দিন ধরে গাজায় নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকাটির বাসিন্দারা এর আগে কখনো এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখেননি।
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এ কয় দিনে ১২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ জনের বেশি শিশু। এই সময়ে দখলকৃত পশ্চিম তীরেও নিহত হয়েছেন প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি। আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে হাসপাতাল—ইসরায়েল বাহিনীর তাণ্ডব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কিছুই।
প্রাণহানির পাশাপাশি গাজার আর্থসামাজিক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক। হামলার মুখে বাড়িঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন উপত্যকার ২৩ লাখ বাসিন্দার অর্ধেকই। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্ধেকের বেশি অবকাঠামো। বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেকের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থাও।
ফিলিস্তিনের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগের তথ্যের বরাত দিয়ে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় গাজার ৪১ হাজারের বেশি বাড়ি সম্পূর্ণ ধসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজারের বেশি বাড়িঘর। সব মিলিয়ে গাজার অন্তত ৪৫ শতাংশ বাড়িঘর পুরোপুরি নয়তো আংশিক ধসে গেছে।
ইসরায়েলের হামলার আগে গাজার বেইত হানুন শহরে বাসিন্দা ছিল অর্ধ লক্ষাধিক। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে গত রোববার শহরটি পরিদর্শনে যান একজন ইসরায়েলি সাংবাদিক। তাঁর বর্ণনায়, ‘শহরটিতে আর এমন একটি ভবনও দাঁড়িয়ে নেই, যেখানে কোনো মানুষ বসবাস করতে পারে।’
জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় গত বুধবার জানায়, ইসরায়েলি হামলায় গাজার ২৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধসে গেছে, নয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংখ্যাটা উপত্যকার মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫১ শতাংশের বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ৬ লাখ ২৫ হাজার।
গত বৃহস্পতিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সবশেষ হিসাব বলছে, গাজায় হাসপাতাল রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৯টি চালু আছে। এগুলোও পুরোপুরি সচল নয়। ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলার মুখে বাকি ২৬ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় জানিয়েছে, মূলত জ্বালানিসংকটে গাজায় একের পর এক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ওষুধ, চিকিৎসার সরঞ্জাম ও রক্তের তীব্র সংকট চলছে।
জ্বালানি না থাকায় গাজার প্রায় সব নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক শরণার্থী সংস্থা। এতে দক্ষিণ গাজার ৭০ শতাংশ বাসিন্দা সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। আর গাজা নগরসহ গোটা উপত্যকার উত্তর অংশে সুপেয় পানি সরবরাহব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে।
আবার গাজার পয়োনিষ্কাশনের কাজে ব্যবহারের জন্য ৬৫টি পাম্প ছিল। এসবের বেশির ভাগই এখন অচল। এতে কিছু এলাকার সড়কে সড়কে পয়োবর্জ্য ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে।
হামলায় ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জ্বালানি, পানি ও আটা-ময়দার সংকটে ৭ নভেম্বর উত্তর গাজার সর্বশেষ বেকারির দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া এখানকার সবশেষ যে কারখানাটি এত দিন চালু ছিল, বুধবার ইসরায়েলের এক হামলায় সেটিও ধসে গেছে। গাজায় খাদ্যসংকটের বর্ণনা দিতে গিয়ে জাতিসংঘ বলছে, ‘সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়কর।’
হামলা শুরুর আগে দৈনিক গড়ে ৫০০টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় ঢুকত। কিন্তু ৭ অক্টোবর থেকে গাজাবাসীর জন্য সব খাদ্যপণ্যের আমদানি বন্ধ। এর দুই সপ্তাহ পর অল্প পরিমাণ ত্রাণ ঢোকা শুরু করে। এরপর থেকে মোট ১ হাজার ১৩৯টি ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকেছে গাজায়। ফলে সিংহভাগ বাসিন্দা অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
জেনারেটরের জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে গাজার টেলিযোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ বলছে, বুধবারও একাধিক যোগাযোগ অবকাঠামোয় হামলা হয়। যোগাযোগব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ায় জীবনরক্ষাকারী সাহায্য পৌঁছানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের দুটি সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলা শুরুর পর থেকে গাজার প্রায় চার লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। হামলার আগেই গাজার আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। ২০২০ সালের হিসাবে, উপত্যকার ৬১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন।
সংস্থা দুটি বলছে, যুদ্ধ কত দিন চলবে, তার ওপর নির্ভর করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। পূর্বাভাসে জানা যাচ্ছে, যুদ্ধে এ বছর গাজার জিডিপিও কমতে পারে ১২ শতাংশ।