২০১৫ সালের কথা। সিরিয়ার শরণার্থীদের সাহায্য করতে গ্রিসে যান মায়া। তিনি একজন ইসরায়েলি ইহুদি। সেই সময় তরুণী মায়া অভিবাসী শিক্ষার্থী হিসেবে জার্মানিতে পড়াশোনা করছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট নৌকায় গ্রিসে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঢোকার ছবি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
গ্রিসে সিরীয় শরণার্থীদের মধ্যে মায়া অনেক ফিলিস্তিনির দেখা পান, যাঁদের জন্ম সিরিয়ায়। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় এসব ফিলিস্তিনির বাবা ও দাদারা পালিয়ে সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
গ্রিসে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া এসব ফিলিস্তিনির কাছ থেকে নাকবা বা মহাবিপর্যয় সম্পর্কে জানতে পারেন মায়া। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে তাঁদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদের ঘটনায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে নাকবা বা মহাবিপর্যয় বলেন ফিলিস্তিনিরা।
মায়ার বয়স এখন ৩৩। তিনি এত দিন জানতেন, শত্রু আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের’ মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের সাক্ষাৎ পাওয়ার পর মায়া ‘শেখানো’ এই ইতিহাস ভুলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
মায়া আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমি এভাবে ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী হওয়ার বিষয়টি জানতাম না।
ইসরায়েল থেকে বেরিয়ে অন্যত্র যাওয়ার পরই মূলত আমি ইসরায়েল সম্পর্কে জানতে শুরু করি। আমার শেখায় যে গলদ আর ফাঁকি ছিল, একমাত্র ইসরায়েল ছাড়ার পরই সে ঘাটতি পূরণ হতে শুরু করে।’
প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার ভয়ে মায়া আল-জাজিরার কাছে তাঁর পুরো নাম প্রকাশে আপত্তি জানান।
ইসরায়েলের যেসব অধিকারকর্মী জায়নবাদবিরোধী ইসরায়েলি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাঁদেরই একজন হলেন মায়া।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইসরায়েলপন্থী একটি গোষ্ঠী অ্যান্টি ডিফামেশন লিগ। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সব ইহুদির সুরক্ষায় শুধু ইহুদিদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য, তাতে অকুণ্ঠ সমর্থনের ধারণা হলো জায়নবাদ।
কিন্তু মায়াসহ তাঁর সঙ্গে কাজ করা জায়নবাদবিরোধী অনেক ইসরায়েলি জায়নবাদকে ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদী একটি ধারণা বলে মনে করেন, যার লক্ষ্য হলো ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা এবং এসব ভূখণ্ডে এখনো যেসব ফিলিস্তিনি রয়েছেন, তাঁদের ওপর পদ্ধতিগত নির্যাতন চালানো, তা হোক ইসরায়েলি নাগরিক বা দখলকৃত ভূখণ্ডের বাসিন্দা।
কিন্তু গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে এসব ইসরায়েলি নাগরিক বিপদে পড়েছেন। নির্বিচার হামলা চালিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনি হত্যার প্রতিবাদ করায় তাঁদের কপালে জুটেছে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা।
গাজায় গণহত্যা চলছে জানিয়ে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এই উপত্যকাতে ইসরায়েলের হামলা বন্ধে অনেকে আহ্বান জানাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, গাজার কিছু লোকের জন্য সবাইকে যে সাজা দেওয়া হচ্ছে, সেটা ‘নারকীয়’।
মায়া আল-জাজিরাকে বলেন, ‘যাঁরা জায়নবাদবিরোধী, তাঁরা সব সময় বলে এসেছেন ৭ অক্টোবরের মতো ঘটনার জবাব ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদ নয়। নাকবা, শরণার্থীজীবন ও নিজভূমে ফেরার অধিকার নিয়ে ফিলিস্তিনিদের গল্পটা ইসরায়েলিরা বুঝতে পারেন না। আমরা যদি ফিলিস্তিনিদের এই গল্প অনুধাবন করতে না পারি, তাহলে হয়তো আমরা বেশি দূরে যেতে পারব না।’
‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা
জায়নবাদবিরোধী ইসরায়েলিরা বলছেন, ৭ অক্টোবরের পর থেকে প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে রয়েছেন তাঁরা। অনেকে বলছেন, যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ দমনে পুলিশ সহিংসতা চালাচ্ছে। অনেকে কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলিদের কাছ থেকে নিয়মিত হুমকি পাচ্ছেন।
মায়ার মতো রোয়ি নামে আরেক ইসরায়েলিও নিজের পূর্ণ নাম প্রকাশ করেননি। এর কারণ হিসেবে তিনিও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিহিংসার মুখে পড়ার আশঙ্কার কথা জানালেন। বললেন, গাজায় ইসরায়েলের বোমা হামলা শুরুর কয়েক দিন পর আরও কিছু ইসরায়েলির সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী এক বিক্ষোভে যোগ দেন তিনি। সেই বিক্ষোভ থেকে হামাসের কাছে থাকা জিম্মি ইসরায়েলিদের মুক্তি ও গাজায় ইসরায়েলি হামলার বন্ধের দাবি জানানো হয়।
পশ্চিম জেরুজালেমের এক ক্যাফেতে বসে ২৮ বছর বয়সী রোয়ির সঙ্গে কথা হয় আল-জাজিরার। তিনি বলেন, ‘আমরা বিক্ষোভ করতে সমবেত হওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে পুলিশ সহিংসভাবে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’
এর কয়েক সপ্তাহ পর জেরুজালেমে একটি থানার সামনে নীরব প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেন রোয়ি।
রোয়ির সঙ্গে নোয়া নামে তাঁর আরও এক বন্ধু ছিলেন। নীরব প্রতিবাদের অংশ হিসেবে তাঁদের মুখ বাঁধা ছিল স্কচটেপ দিয়ে। এরপরও পুলিশ সে বিক্ষোভে চড়াও হয় ও বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করে।
নোয়া বলেন, ‘আমি খুব ভালো করেই জানি, পুলিশ আমাদের সম্পর্কে জানে। তারা আমাদের ভালোভাবেই চেনে। তারা এটা জানে, আমরা বামপন্থী এবং এই কারণেই তারা আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বর্ণনা করে থাকে।’
যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার এমন ইসরায়েলিদের এভাবে রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রতি বিদ্বেষও ছড়ানো হয়। আর এর মধ্য দিয়ে এসব ইসরায়েলির কণ্ঠরোধের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
মায়া জানালেন, কট্টর ডানপন্থী অনেক ইসরায়েলি অভিযোগ তুলেছিলেন, তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে হামাসের আঁতাত আছে। তিনি হামাসের কাছে ইসরায়েলের অবস্থান-সংক্রান্ত তথ্য পাচার করেন। এসব মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাঁর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় প্রকাশ করেছিলেন এসব ইসরায়েলি।
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে সোচ্চার ইসরায়েলিরা বলছেন, নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলা বন্ধের দাবি তুলে নেতানিয়াহু সরকার ও অন্য অনেক ইসরায়েলির রোষের মুখে পড়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের আশা, একদিন না একদিন তাঁদের এমন অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন অন্যরা। কারণ, এসব ফিলিস্তিনিও তো তাঁদের মতোই মানুষ।