ইসরায়েলের লাগামহীন সামরিক তৎপরতার জবাব দিল ইরান। ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার মানুষ হত্যাসহ সিরিয়া ও লেবাননে কয়েক মাস ধরে বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে আসছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এমনই এক হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা নিহতের বদলায় ইসরায়েলে হামলা চালাল তেহরান। গত শনিবার রাতে ইসরায়েল লক্ষ্য করে তিন শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইরানের ভূখণ্ড থেকে সরাসরি ইসরায়েলে হামলা চালানো হলো।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জর্ডানের সহযোগিতায় এ হামলায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে ইসরায়েল। এ ক্ষেত্রে দেশটির উন্নত প্রযুক্তির কয়েক স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও বড় ভূমিকা রেখেছে। ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের বেশির ভাগই আকাশে ধ্বংস করা হয়েছে। নয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ও গুটিকয় ড্রোন ইসরায়েলে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। তাতে দুটি বিমানঘাঁটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত এবং একটি শিশু গুরুতর আহত হয়েছে।
এ হামলায় ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতি ততটা না হলেও মধ্যপ্রাচ্যে এর বড় প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালালে তাতে দুই দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এ অঞ্চল বা বিশ্ব কেউই আরও যুদ্ধের ক্ষতি সামলাতে পারবে না।
ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৩৩ হাজার ৭৯৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ত্রাণ ঢুকতে না দেওয়ায় খাবারের অভাবে ধুঁকছেন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। এ পরিস্থিতিতে ওই অঞ্চলে নতুন করে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তা বিপর্যয় নিয়ে আসবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের প্রতি ইরানে পাল্টা হামলা না চালানোর আহ্বান জানিয়েছে দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো যুদ্ধ চায় না। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি গতকাল সোমবারও ইসরায়েলের নেতাদের প্রতি সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গতকাল এক বৈঠকে ইরানের হামলার জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। তাতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী–আইআরজিসির বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী কুদস ফোর্সের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এ হামলার বদলা নেওয়ার ঘোষণা দেয় ইরান। এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে একযোগে ১৭০টি ড্রোন, ১২০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। ইসরায়েলি বাহিনীর ভাষ্যমতে, সেসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই আকাশে থাকতে ধ্বংস করা হয়। আগে থেকে ওই অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড এ হামলা রুখতে বড় ভূমিকা রাখে। সিরিয়ায় আগে থেকে অবস্থানরত যুক্তরাজ্যের জঙ্গি বিমানগুলোও এতে অংশ নেয়। এ হামলা প্রতিহতে সেখানে আরও যুদ্ধবিমান পাঠায় যুক্তরাজ্যের রয়েল এয়ার ফোর্স। ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীও তাতে ভূমিকা রাখে। পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা ইসরায়েলের প্রতিবেশী দেশ জর্ডানও তাদের আকাশসীমায় ইরানের ছোড়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে।
ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, তাদের যে বিমানঘাঁটি আক্রান্ত হয়েছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সামান্য। তবে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাগেরি বলেছেন, ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলায় জড়িত ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাগুলোকে এ হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। হামলায় হেরমন পর্বতে ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা ঘাঁটি ও নেগেভ মরুভূমিতে ইসরায়েলের নেভাটিম বিমানঘাঁটির উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ওই রাতে ইসরায়েলের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ৪১ বছর বয়সী মোরান নামের এক নারী বিবিসিকে বলেন, ‘এটা একটি ভয়ানক রাত ছিল। শিশুরা সারা রাত ঘুমাতে পারেনি।’
ইসরায়েলে ইরানের হামলা নিয়ে রোববার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি সভা হয়। সেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ একটি পূর্ণমাত্রার ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। তাঁরা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এখনই সময় তাঁদের খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনার। আর এ দায়িত্ব যৌথভাবে সবার।
ইসরায়েল যদি এখন ইরানের ভূখণ্ডে পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত জটিল হতে পারে বলে মনে করেন ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরানবিষয়ক প্রকল্পের পরিচালক আলী ভায়েজ। তিনি বলেছেন, এতে আগে থেকে অস্থিতিশীল থাকা একটি অঞ্চল আরও সংকটে পড়বে।
মধ্যপ্রাচ্য যে সংকটে রয়েছে, তা মনে করেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক দাউদ কাত্তাবও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ইসরায়েল ও ইরান যে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে, তা আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশকে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। ভয়টা হলো, ইতিমধ্যেই বিধ্বস্ত এই অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার। আর এমনটা সত্যিই যদি ঘটে, তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী পড়বে।