ফিলিস্তিনের দক্ষিণ গাজায় গত বুধবার ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে হামাসপ্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের বন্দুকযুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে তিনি নিহত হন। অভিযানে অংশ নেওয়া ইসরায়েলি সেনারা প্রাথমিকভাবে জানতেন না যে তাঁরা তাঁদের দেশের ১ নম্বর শত্রুকে পেয়ে গেছেন। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মাসের পর মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় সিনওয়ারকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের প্রধান সিনওয়ার গাজার যেসব জায়গায় অবস্থান নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারেন, এমন এলাকার পরিসর ধীরে ধীরে সীমিত করে আনছিলেন ইসরায়েলি সেনারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বুধবার দক্ষিণ গাজায় অভিযান চালিয়ে সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে। আঙুলের ছাপসহ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে সিনওয়ার নিহত হয়েছেন।
সিনওয়ারের মৃত্যুর বিষয়ে হামাস কোনো মন্তব্য করেনি। তবে সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, তারা যেসব ইঙ্গিত পাচ্ছে, তাতে মনে হয়, সিনওয়ারকে ইসরায়েলি সেনারা হত্যা করেছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, এক বছর ধরে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ও নিরাপত্তা সংস্থা (আইএসএ) গাজায় অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে। এমনকি যে এলাকায় সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে, সেই এলাকায় সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানের ফলে সিনওয়ারের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছিল। ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে তাড়া করে চলছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে নির্মূল করা হলো।
গত ১৩ জুলাই ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ। তিনিসহ আরও অনেক হামাস নেতাকে ইসরায়েল হত্যা করেছে পরিকল্পিত অভিযান ও সুনির্দিষ্ট নিশানাকেন্দ্রিক হামলা চালিয়ে। অর্থাৎ অবস্থান শনাক্ত করে হামলা চালিয়ে তাঁদের হত্যা করা হয়। কিন্তু সিনওয়ার হত্যার অভিযানটি পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট নিশানাকেন্দ্রিক ছিল না।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, বুধবার দক্ষিণ গাজার তেল আল সুলতান এলাকায় তল্লাশি-অনুসন্ধান চালানোর সময় সিনওয়ারকে পেয়ে যান ইসরায়েলের পদাতিক সেনারা। এলাকাটিতে হামাসের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য অবস্থান করছেন, এমনটা ভেবে অভিযান চালাচ্ছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। সেখানে সিনওয়ারের থাকার বিষয়টি জানতেন না ইসরায়েলি সেনারা।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানান, অভিযানকালে সেনারা তিনজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বিভিন্ন ভবনের মধ্য দিয়ে সরে যেতে দেখেন। একপর্যায়ে তাঁরা গুলি চালান। দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ সময় সিনওয়ার সরে গিয়ে একটি বিধ্বস্ত ভবনে ঢুকে পড়েন।
ইসরায়েলের গণমাধ্যমের বিবরণ অনুযায়ী, পরবর্তী সময়ে ভবনটি লক্ষ্য করে ট্যাংক দিয়ে একাধিক গোলা ছোড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। এ ছাড়া তারা একটি ক্ষেপণাস্ত্রও ছোড়ে।
গতকাল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী একটি ছোট ড্রোন থেকে নেওয়া ফুটেজ প্রকাশ করে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, ফুটেজে যে ব্যক্তিকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়, তিনি সিনওয়ার। তাঁর হাতে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। তাঁর মুখ স্কার্ফে ঢাকা। ফুটেজে দেখা যায়, তিনি ড্রোনটির দিকে একটি লাঠি ছুড়ে মারার চেষ্টা করছেন। তিনি এভাবে ড্রোনটিকে ফেলে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, অভিযানকালে সিনওয়ারকে শুধু একজন হামাস যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। তাঁর সঙ্গে ছিল একটি অস্ত্র, একটি প্রতিরক্ষামূলক জ্যাকেট ও ৪০ হাজার ইসরায়েলি মুদ্রা শেকেল।
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ব্রিফিংয়ে ড্যানিয়েল হাগারি সাংবাদিকদের বলেন, সিনওয়ার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে নির্মূল করে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। সে সময় গাজায় হামাসের প্রধান ছিলেন সিনওয়ার। তাঁকে এই হামলার প্রধান কারিগর মনে করা হয়।
ইসরায়েল সরকারের তথ্য অনুসারে, হামাসের এই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এ ছাড়া প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
জবাবে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলি হামলায় ৪২ হাজার ৪৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গত জুলাই মাসে ইরানের রাজধানী তেহরানে গুপ্তহত্যার শিকার হন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। তাঁকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়। হানিয়া হত্যার পর হামাসের সামগ্রিক নেতা হন সিনওয়ার।
সিনওয়ার তাঁর জীবনের শেষ মাসগুলোতে টেলিফোন ও অন্যান্য যোগাযোগ সরঞ্জাম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যাতে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তাঁকে খুঁজে না পান।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁদের ধারণা, সিনওয়ার গত দুই দশক গাজায় হামাসের বানানো সুড়ঙ্গের সুবিশাল নেটওয়ার্কের মধ্যে লুকিয়ে থেকে তৎপরতা চালিয়ে আসছিলেন। তবে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি সেনারা একের পর এক সুড়ঙ্গ খুঁজে বের করছিলেন। এর ফলে সুড়ঙ্গে অবস্থান করাটা তাঁর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হার্জি হালেভি বলেছেন, গত এক বছর ধরে তাঁরা সিনওয়ারকে তাড়া করে চলছিলেন। ইসরায়েলি বাহিনীর এই তাড়া সিনওয়ারকে একজন পলাতক ব্যক্তির মতো পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য করে। অনেকবার স্থান পরিবর্তন করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের চোখে সিনওয়ার একজন ‘নির্মম’ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রু। তাঁরা ধারণা করছিলেন, তিনি নিজেকে ইসরায়েলি হামলা থেকে রক্ষায় জিম্মিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁকে ধরার জন্য অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অনেক দিন ধরেই উদ্বিগ্ন ছিলেন।
কিন্তু বুধবার যখন সিনওয়ারকে ঘিরে ফেলা হয়, হত্যা করা হয়, তখন কাছাকাছি কোনো জিম্মিকে পায়নি ইসরায়েলি বাহিনী। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, কয়েক শ মিটার দূরের একটি সুড়ঙ্গে তাঁর ডিএনএ নমুনা পাওয়া যায়। এখানে গত আগস্টের শেষের দিকে ছয় ইসরায়েলি জিম্মিকে হত্যা করেছিল হামাস।
গাজা যুদ্ধের শুরুতে হামাসকে নির্মূলের অঙ্গীকার করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গতকাল নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে তাঁর একটি ভিডিও বিবৃতি প্রচার করা হয়। এতে তিনি বলেন, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহসী সেনাদের হাতে সিনওয়ার নিহত হয়েছেন। যদিও এটি গাজা যুদ্ধের শেষ নয়, এটি শেষের শুরু।
সিনওয়ারকে হত্যার বিষয়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে ঘোষণা আসার পর হামাসের ঘনিষ্ঠ মিত্র লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বলেছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নতুন এক অধ্যায় শুরু করছে। আর ইরান বলেছে, সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ডে এই অঞ্চলে প্রতিরোধ আরও জোরালো হবে।