ইসরায়েল ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর পাল্টাপাল্টি হুমকির পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যদি ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে সেটা হবে আরেকটি ‘বিপর্যয়’। তবে প্রায় প্রতিদিন হামলার আতঙ্কে থাকেন ইসরায়েলি সীমান্তের এমন একজন বাসিন্দা ডেভিড কামারির মতে, দুই পক্ষের মধ্যে সর্বাত্মক একটি যুদ্ধই হতে পারে এর সমাধান।
ডেভিড কামারি লেবানন সীমান্তবর্তী ইসরায়েলের ছোট শহর কিরইয়াত শামোনার বাসিন্দা। গত মাসে লেবানন থেকে ছোড়া হিজবুল্লাহর একটি রকেট গিয়ে আঘাত হানে তাঁর বাড়ির বাগানে। রকেটের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর বাড়ি। ডেভিড কামারি বলেন, ‘দিন-রাত সর্বদা বোমার আতঙ্ক। এটা এক বড় সমস্যা। আমার জন্ম এখানে। আপনি যদি এখানে একটি রাত থাকেন, তাহলে পাগল হয়ে যাবেন।’
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার শাসকগোষ্ঠী হামাস। এর পর থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় এই হামলার প্রতিবাদে ইসরায়েলে নিয়মিত রকেট হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ। এ পরিস্থিতিতে কিরইয়াত শামোনা শহরের অধিকাংশ বাসিন্দাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডেভিড কামারি তাঁর বাড়িতে আছেন।
ডেভিড কামারি বলেন, ‘আমি ৭১ বছর ধরে এখানে আছি। কোথাও যাব না। আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম। আমি ভীত নই।’ তাঁর মতে, হিজবুল্লাহর সঙ্গে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধই এ সংঘাতের সমাধান।
হিজবুল্লাহর হামলার কড়া জবাব দিচ্ছে ইসরায়েল। লেবাননের ভেতরে হিজবুল্লাহর অবস্থান নিশানা করে হামলা চালাচ্ছে নিয়মিত। হামলায় হিজবুল্লাহর একাধিক শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলে চলতি মাসে ব্যাপক পরিসরে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করেছে হিজবুল্লাহ। এর মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের মাত্রা আরও বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। চলতি মাসে হিজবুল্লাহ ড্রোন থেকে তোলা বেশ কিছু ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছে। এসব ভিডিও চিত্রে ইসরায়েলের হাইফা শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর একাধিক সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি বেসামরিক বিভিন্ন অবকাঠামোও দেখা গেছে।
দুই পক্ষের কেউই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে চায় না—এমন আলোচনা থাকলেও বর্তমানের পরিস্থিতি অবশ্য ভিন্ন। এর বড় কারণ পাল্টাপাল্টি হামলার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে ৬০ হাজারের বেশি ইসরায়েলিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের নেতারা ও জনগণও বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালিয়ে হিজবুল্লাহকে পিছু হটতে বাধ্য করার পক্ষে।
কিরইয়াত শামোনার মেয়র আভিচাই স্টার্নের কার্যালয়ের অদূরে একটি সড়কে সম্প্রতি আঘাত হানে হিজবুল্লাহর ছোড়া রকেট। মেয়র আভিচাই স্টার্ন বললেন, ‘এখানে থাকা মানে কসাইয়ের সম্মুখে ভেড়া হয়ে বসে থাকার মতো। অপেক্ষা করা কোন দিন তারা (হিজবুল্লাহ) দক্ষিণাঞ্চলের মতো (হামাসের হামলা) আমাদের এখানে এসেও হামলা চালায়। সবাই জানে এখন বা পরে এই যুদ্ধ একদিন হবেই হবে।’
লেবানন সীমান্তের বিপজ্জনক এই অচলাবস্থা মূলত নির্ভর করছে দক্ষিণে ১০০ মাইল দূরে গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধের ওপর। একটি যুদ্ধবিরতি হলে উত্তরেও উত্তেজনা প্রশমনে তা সহায়ক হবে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চান, দুই দিকেই সংঘাত অব্যাহত থাক। কট্টর ডানপন্থী সরকারের মিত্রদের কাছে হামাসকে নির্মূলের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অর্জন করতে চান তিনি।
নেতানিয়াহু ও তাঁর কট্টর ডানপন্থী মিত্রদের এ লক্ষ্য যে পূরণ হওয়ার নয়, সেই ইঙ্গিত আসছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী থেকেই। গত সপ্তাহে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগেরি বলেছেন, হামাসকে নির্মূলের এই লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয়। ইসরায়েলি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমরা হামাসকে নির্মূল করতে পারব, এমন কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।’
লেবাননের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারাও আছেন আতঙ্কে। ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়মিত হামলার মুখে সীমান্তবর্তী এলাকার প্রায় এক লাখ বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখনো যাঁরা বাড়িতে আছেন, তাঁদেরও থাকতে হচ্ছে আতঙ্কের মধ্যেই। তাঁদের মধ্যে অনেকের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ বসতভিটা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না বলে ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন।
ইসরায়েল সীমান্ত থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে লেবাননের জাবাল আল বতম এলাকার বাসিন্দা ফাতিমা বেলহাস। শুরুর দিকে বাড়ির আশপাশের এলাকায় বোমা হামলা হলে ভয় আর আতঙ্কে কেঁপে উঠতেন বলে জানালেন এই নারী। বলেন, এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিন লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি হামলা চলছে। ধীরে ধীরে একটা সময় তা ‘গা সওয়া’ হওয়ায় এখন বাড়ি ছাড়তে চান না।
এ ছাড়া তাঁর অন্য কোথায় যাওয়ার জায়গা নেই বলে জানালেন ফাতিমা বেলহাস। বলেন, ‘কোথায় যাব? অন্যদের না হয় আত্মীয় আছে নানা জায়গায়। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে তো তাঁদের আত্মীয় বাড়ি যাওয়া যায় না। এ ছাড়া আমাদের কাছে অর্থকড়িও নেই। হয়তো বাড়িতে থেকে আত্মসম্মান নিয়ে মারা যাওয়াই ভালো। আমরা এসব দেখে দেখে বড় হয়েছি। ফিলিস্তিনিদের মতো আমরা বাড়িঘর ছাড়ব না।’
ইসরায়েলের সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে লেবাননের একটি গ্রাম মাইস আল জাবাল। সেই গ্রামের বাসিন্দা হুসেইন আবাল্লান সম্প্রতি তাঁর বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তিনি বলেন, দিন দিন সেখানে জীবন যাপন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। যোগাযোগের ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ থাকে না। এ ছাড়া গ্রামে বা আশপাশের এলাকায় কোনো দোকানও খোলা পাওয়া যায় না।
হুসেইন আবাল্লান বলেন, গ্রামে আর অল্প কিছু পরিবার আছে। মূলত যেসব পরিবারে প্রবীণেরা আছেন বা যাঁরা ফসলের খেত রেখে যেতে চান না, তাঁরাই রয়ে গেছেন। তবে হিজবুল্লাহ এখন ইসরায়েলে যে হামলা চালাচ্ছে তিনি তাঁর পক্ষে বলে জানালেন। বলেন, ‘লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বছরের পর বছর ইসরায়েলি আগ্রাসনে বাস করছে। শুধু প্রতিরোধের মাধ্যমে আমরা শক্তিশালী হতে পারি।’
সীমান্তের এই সংঘাত নিয়ে উভয় দেশের মানুষ সংকটের মধ্যে রয়েছেন। তবে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যদি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তাঁদের এই দুর্দশা ভিন্ন এক মাত্রায় গিয়ে ঠেকবে।
আতঙ্ক শুধু সীমান্তবর্তী এলাকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। লেবাননের রাজধানী বৈরুতেও অনেকে যুদ্ধের আতঙ্কে রয়েছেন। কেউ কেউ তো ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছেন। ঠিকঠাক করে রেখেছেন পাসপোর্ট। তাঁরা বলছেন, যদি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে যেন দ্রুত অন্যত্র যেতে পারেন বা দেশ ছাড়তে পারেন। হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসারাল্লাও বলেছেন, যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলের কোনো অংশ বাদ যাবে না।
হিজবুল্লাহর কাছে রয়েছে যুদ্ধ করার মতো সমরাস্ত্র। ইরান তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর। এদিকে বিশ্বের অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র রয়েছে ইসরায়েলের কাছে। আর ইসরায়েলের অন্যতম মিত্র সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে উভয় পক্ষের জন্য সেটা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।