হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা। গত রোববারের এ দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ হিসেবে বৈরী ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে এর নেপথ্যে আরও কিছু কারণ নিয়েও চলছে আলোচনা।
ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের জোলফা নামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ছিল ঘন কুয়াশা। বৃষ্টিও হচ্ছিল। দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়, বৈরী আবহাওয়ার কারণে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়।
হেলিকপ্টারটি কীভাবে বিধ্বস্ত হলো, তা খতিয়ে দেখতে দুর্ঘটনার পরদিন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইরান। এ বিষয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে রাশিয়া বলেছে, ইব্রাহিম রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার সঠিক কারণ উদ্ঘাটনে করতে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দিতে প্রস্তুত তারা।
রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের কারণ সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এভিয়েশন সেফটি এজেন্সি (ইএএসএ) বলছে, উঁচু পার্বত্য এলাকা ও গভীর উপত্যকার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় পাইলট বিভ্রান্ত হতে পারেন। এ ধরনের পরিবেশে চলাচল করা একজন পাইলটের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত ক্লান্তির।
ইএএসএ বলছে, গভীর উপত্যকায় বাতাসের গতি ও দিক আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে পাল্টে যেতে পারে। এ কারণে বাতাসের গতি উল্লেখ করার মতো ওঠানামা করতে পারে। এতে করে অনেক সময় হেলিকপ্টারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন পাইলট। এ ছাড়া এসব জায়গা দিয়ে চলাচলের সময় কুয়াশা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি বিষয়।
তবে কাইল বেইলি নামের একজন বেসামরিক বিমান পরিবহনবিশেষজ্ঞ আল-জাজিরাকে বলেন, বিধ্বস্ত হওয়ার আগে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের পাইলটরা সহায়তা চেয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি। ফলে কোনো সন্দেহ নেই যে যান্ত্রিক ক্রটির কারণেই হেলিকপ্টারটি নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যার মুখে পড়েছিলেন তাঁরা।
কাইল বেইলি আরও বলেন, আকাশে থাকতে যান্ত্রিক সমস্যার মুখে পড়লে পাইলটের প্রথম কাজ হেলিকপ্টার আকাশে ভাসিয়ে রাখা। এরপরে সহায়তার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা। তবে তার আগেই হয়তো হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। অবশ্য বৈরী আবহাওয়ার কারণেও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী ওই হেলিকপ্টারটি ছিল বেল-২১২ মডেলের। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এই হেলিকপ্টার ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে কিনেছিল তেহরান। সে হিসাবে এটি বেশ পুরোনো। এর আগেও একবার ইরানে এই মডেলের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল।
বেসামরিক বিমান পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। বৈরী আবহাওয়া এর মধ্যে অন্যতম। হেলিকপ্টারটি অনেক পুরনো মডেলের হওয়াকেও অন্যতম কারণ বলেও মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বেল ২১২ হেলিকপ্টার বাজারজাত শুরু হয়। গত শতকের সত্তরের দশকে ইরান এই মডেলের অনেকগুলো হেলিকপ্টার কেনে। সেই সময় ইরানের শাসনক্ষমতায় ছিলেন মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শাহের পতন ঘটার পরও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে ইরান। অনেকগুলো এখনো ইরানের বহরে আছে। তবে বিপ্লবের পর তেহরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব মেরামতে যন্ত্রাংশ কেনাটা ইরানের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।
এসব কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইরানের বহরে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উড়োজাহাজ, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। অবশ্য এসব সচল রাখতে চোরাপথেও কিছু যন্ত্রাংশ এনেছে তেহরান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত যন্ত্রাংশ না পেলে এসব সচল রাখা বেশ কঠিন।
২০১৯ সালের হিসাবে ইরানের ২৩টি এয়ারলাইন্সের বহরে তিন শতাধিক উড়োজাহাজ ছিল। সেই সময় এর মধ্যে মাত্র ১৫৬টি উড়োজাহাজ চলাচল করছিল। অর্থাৎ অর্ধেক উড়োজাহাজ বসে থাকছিল। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির দেওয়া তথ্যমতে, মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশ না থাকায় এসব উড়োজাহাজ বসিয়ে রাখা হয়েছে।
মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ না পাওয়ার কারণে এসবের নিরাপত্তা নিয়েও দেখা দেয় উদ্বেগ। এতে করে ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা। মোহাম্মদ রেজা পাহলভির সময়ে কেনা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার একাধিক ঘটেছে ইরানের বিমানবাহিনীতে।
ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানে অসংখ্য বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব বিমানের প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক ব্যুরো অব এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট আর্কাইভসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ইরানের ২৫৩টি বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩৩৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেল ২১২ হেলিকপ্টারের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ২০২১ সালে কানাডা জানায়, তারা আর বেল ২১২ মডেলের হেলিকপ্টার ব্যবহার করবে না। বেল ২১২ নিয়ে করা এক তদন্তে এই হেলিকপ্টার উড্ডয়নের সময়ে নানান যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি উঠে আসার পর এমন সিদ্ধান্ত নেয় কানাডা।