পবিত্র আল-আকসায় প্রবেশ করা উগ্রপন্থী ইহুদি গোষ্ঠীগুলো কারা

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলোর একটি জেরুজালেমে অবস্থিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ
ছবি: এএফপি

পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর গত সপ্তাহে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদি গোষ্ঠীগুলোকে মসজিদটির ভেতরে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিতেই এ হামলা হয় ফিলিস্তিনিদের ওপর। পুলিশের প্রহরায় উগ্রপন্থী এসব ইহুদি আল-আকসা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছিলেন।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পূর্ব জেরুজালেমের ওল্ড সিটিতে আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত। মসজিদের প্রাঙ্গণেই রয়েছে ডোম অব দ্য রক। ইহুদিরা আল-আকসা প্রাঙ্গণকে টেম্পল মাউন্ট বলেন। তাঁদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, একসময় সেখানে ইহুদিদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রাচীন উপাসনালয় ছিল।

পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি পুলিশ অভিযান চালায়, গ্রেপ্তার করে ৩৫০ ফিলিস্তিনিকে

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পূর্ব জেরুজালেমের ভূমি দখল ও তা অধিগ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তবে এ সত্ত্বেও ইসরায়েল ওল্ড সিটি ও আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণসহ পুরো জেরুজালেমকে নিজেদের সার্বভৌম ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে আসছে। কিন্ত ইসরায়েলের এ দাবি বেআইনি ও বেশির ভাগ দেশ বিষয়টির স্বীকৃতি দেয়নি।

জর্ডানের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তি অনুযায়ী আল-আকসা মসজিদের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক বিষয় দেখভাল করে জর্ডানীয় ওয়াক্‌ফ। আর মসজিদ প্রাঙ্গণ ঘিরে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ইসরায়েলের। ওয়াক্‌ফের সঙ্গে সমন্বয় করে অমুসলিমদের মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশের বিষয়ও দেখে ইসরায়েল। যেসব উগ্রপন্থী ইহুদি গোষ্ঠীকে উসকানিদাতা বলে মনে হয়, এ প্রাঙ্গণে তাদের ঢুকতে দেওয়া নিষিদ্ধ।

পবিত্র আল-আকসায় নামাজ আদায় করতে আসা ফিলিস্তিনি মুসলিমদের সরিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েলি পুলিশ

গত শতকের আশির দশকে ‘জিউস আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামে একটি কট্টরপন্থী ইহুদি গোষ্ঠী ডোম অব দ্য রক ভেঙে ফেলার চক্রান্ত করে। এরপর নব্বইয়ের দশকে আল-আকসা প্রাঙ্গণে একটি বিক্ষোভ চলাকালে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ১৭ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৫০ জন আহত হন। ‘টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল’ নামে কট্টরপন্থী একটি ইহুদি গোষ্ঠী আল-আকসা প্রাঙ্গণে একটি টেম্পল নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের চেষ্টা করলে এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভে নেমেছিলেন।

গত সপ্তাহে দুদিন ৪০টি দলে ভাগ হয়ে ২ হাজারের বেশি ইহুদি আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢোকেন। তাঁদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যায় ইসরায়েলি বাহিনী। মসজিদের ভেতরে থাকা ফিলিস্তিনিরা তাঁদের বাধা দেয়। তখন ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে পুলিশ স্টান গ্রেনেড ও রাবার বুলেট ছোড়ে। গ্রেপ্তার করা হয় ৩৫০ ফিলিস্তিনিকে।
এসব ইহুদি গোষ্ঠী কারা

উগ্রপন্থী বিভিন্ন ইহুদি গোষ্ঠী প্রায়ই তাদের সমর্থকদের নিয়ে পবিত্র আল-আকসার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে

আল-আকসা মসজিদে যাওয়ার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে আয়োজন করে ‘টেম্পল মাউন্ট গ্রুপস’ নামে কয়েকটি উগ্রপন্থী ইহুদি গোষ্ঠী। কৌশলগত দিক থেকে তাদের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও একটা জায়গায় তারা এক। সেটা হলো আল-আকসা মুসলিমদের পবিত্র স্থান—এ বিষয়টি বদলে ফেলার লক্ষ্য অর্জন করা।  

টেম্পল মাউন্ট নিয়ে সক্রিয় ২০টির বেশি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী আছে। এর মধ্যে একটি গোষ্ঠী তাদের সদস্যদের আল-আকসায় নিয়ে যাওয়ার আয়োজন করে ও সেখানে ইহুদিদের প্রার্থনা করার বিষয়ে উৎসাহ দেয়। এ ছাড়া অন্য যেসব গোষ্ঠী রয়েছে তাদের কাজ মূলত ‘গবেষণা করা’ এবং এ–বিষয়ক ‘তথ্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া’।  
সবচেয়ে পুরোনো ও সক্রিয় গোষ্ঠীগুলোর একটি টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল। ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ গোষ্ঠীই মূলত আল-আকসা প্রাঙ্গণে ইহুদিদের নিয়ে যায়।

আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শন নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল নামের গোষ্ঠী জানায়, ইহুদিদের প্রার্থনা করার জন্য টেম্পল মাউন্ট খুলে দিতে ইসরায়েল সরকারের প্রতি আহ্বান ও তৃতীয় একটি টেম্পল প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে সেখানে যায় তারা।

বেয়াদেনু নামে নেতৃস্থানীয় আরেকটি ইহুদি গোষ্ঠী বলেছে, তারা আল-আকসা মসজিদ ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। গোষ্ঠীটি আরও বলেছে, তাদের শত শত সমর্থক আছেন। যাতে সত্যি সত্যিই টেম্পল মাউন্টকে ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনা যায়, সে জন্য অবশ্যই হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে ইসরায়েলের পার্লামেন্টে বেয়াদেনুর একটি সমর্থক গোষ্ঠী আছে। পুলিশবিষয়ক মন্ত্রী বেন গিভিরসহ সরকারের একাধিক সদস্য এ দলে আছেন।

আল-আকসায় ইহুদিদের নিয়ে যায় এমন আরেকটি গোষ্ঠী হলো রিটার্ন টু দ্য টেম্পল মাউন্ট বা হিব্রুতে খোজরিম লা-হার। এই গোষ্ঠীর দাবি, আল-আকসা ‘বিদেশিদের’ হাতে থাকা উচিত নয়। সেখানে নতুন একটি টেম্পল নির্মাণ হোক এমনটা যাঁরা চান, তাঁদের এ গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার উৎসাহও দিয়ে থাকে তারা।  

রিটার্ন টু দ্য টেম্পল মাউন্ট নামের এ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন রাফায়েল মরিস। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ইহুদিদের অনেকগুলো স্বপ্নের একটি আল–আকসায় টেম্পল নির্মাণ করা। আল-আকসাকে শতভাগ ইসরায়েলের ভূখণ্ড মনে করেন তিনি।  

২০১৭ সালে মরিস বলেছিলেন, ‘যখন আমরা বলতে পারব, টেম্পল মাউন্ট আমাদের ও শুধুই আমাদের; আর সেখানে অন্য কারও স্থান নেই, তখনই আমরা শুধু টেম্পল মাউন্ট নয়, একই সঙ্গে জর্ডান ও সিরিয়াও জয় করতে পারব। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের সমগ্র ভূখণ্ড নিয়ে একটি সত্যিকার ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’

ইহুদিদের আল-আকসায় নিয়ে যাওয়া ও সেখানে তৃতীয় একটি টেম্পল নির্মাণের প্রচারণা চালানোর কেন্দ্রে রয়েছে দ্য টেম্পল ইনস্টিটিউট নামের একটি সংগঠন। এটি বলছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, বর্তমানে যেখানে ডোম অব রকের অবস্থান, সেখানে তৃতীয় একটি টেম্পল নির্মাণ ও প্রার্থনার আয়োজন করা।  

দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ চলতি মাসের শুরুর দিকে বলেন, ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের যে আকাঙ্ক্ষা, তা হলো আল-আকসা মসজিদ ভেঙে ফেলা অথবা বলপ্রয়োগ করে সেটির পুরোটা বা বিশেষ অংশে একটি সিনাগগ তৈরি করে প্রার্থনার বন্দোবস্ত করা। এর আগে হেব্রনে ইব্রাহিমি মসজিদে যেটা হয়েছিল। ইব্রাহিমি মসজিদ নিয়ে বসতি স্থাপনকারীদের সেই ঘটনা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।