ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের আকাশে ড্রোন ধ্বংসের দৃশ্য। ২৫ আগস্ট ২০২৪
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের আকাশে ড্রোন ধ্বংসের দৃশ্য। ২৫ আগস্ট ২০২৪

ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ যুদ্ধ চায় না, তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে রোববার ভোররাতে উড়ে যায় প্রায় এক শ ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান।

পরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, তাদের যুদ্ধবিমানগুলো হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে আগাম হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলের পক্ষে দাবি করা হয়, হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা বড় পরিসরে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাই তারা আগাম হামলা চালিয়েছে। এর ফলে হিজবুল্লাহর বড় হামলা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে।

জবাবে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে একের পর এক রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহর হামলা ব্যাপক ও ভয়ানক হতে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে ইসরায়েলজুড়ে ৪৮ ঘণ্টার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার।

যদি ১০০ যুদ্ধবিমান পাঠানোর দাবি ঠিক হয়, তাহলে ২০০৬ সালের পর এটা লেবাননে হিজবুল্লাহ বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। ২০০৬ সালে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে ৩৪ দিনের পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ হয়েছিল।

রোববার স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে চারটার দিকে লেবাননে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী।

বলা হচ্ছে, ভোর পাঁচটার দিকে ইসরায়েলে বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ।

লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ। গতকাল রোববার টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে

ইসরায়েলের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন করেছে, গতকাল হিজবুল্লাহর ছোড়া রকেট ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শহর তেল আবিবে পর্যন্ত আঘাত হেনেছে।

অর্থাৎ হিজবুল্লাহর রকেট ইসরায়েলের অনেক ভেতরে—একেবারে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

হিজবুল্লাহর পাল্টা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরায়েল।

গতকাল হিজবুল্লাহ জানায়, তারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা নিশানা করে তিন শতাধিক রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে।

হিজবুল্লাহর হামলার কারণে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলজুড়ে আকাশপথে হামলার বিষয়ে নাগরিকদের সতর্ক করতে বাজানো হয় বিপৎসংকেত (সাইরেন)।

দুই পক্ষের মধ্যে সর্বশেষ এই পাল্টাপাল্টি হামলার জেরে অঞ্চলজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমবর্ধমান এই সংঘাত দুই পক্ষের মধ্যে আবার পূর্ণমাত্রার আরেকটি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে বলে অনেকের মধ্যে আশঙ্কা কাজ করছে।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ইসরায়েলে পাল্টা হামলার পর বিবৃতি দেয় হিজবুল্লাহ। বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৩০ জুলাই লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ফুয়াদ শোকরকে হত্যা করে ইসরায়েল। এই হত্যার বদলা নিতেই তারা ইসরায়েলে বিপুলসংখ্যক রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন ছুড়েছে। এর মধ্য দিয়ে হামলার ‘প্রথম পর্যায়’ সম্পন্ন হয়েছে।

পরদিন ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে এক গুপ্ত হামলায় নিহত হন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া। হানিয়াকে হত্যার পেছনে ইসরায়েলকে দায়ী করেছে ইরান ও হামাস। তবে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছু বলেনি ইসরায়েল।

হামাস ও হিজবুল্লাহর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। গত ৭ অক্টোবর গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে হামাসের সমর্থনে ইসরায়েলে ক্রমবর্ধমানভাবে হামলা চালিয়ে আসছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলছে।

শোকর হত্যার পর হিজবুল্লাহ ও হানিয়া হত্যার পর ইরান বদলা নেওয়ার ঘোষণা দেয়। বদলা হিসেবে হিজবুল্লাহ ও ইরান কখন কী ব্যবস্থা নেয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করে আসছিল পুরো অঞ্চল।

হিজবুল্লাহ গতকাল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিল। তবে ইরানের দিক থেকে এখনো কোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

আকাশে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। ২৫ আগস্ট ২০২৪

১০ মাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই যুদ্ধ যাতে বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ না নেয়, সে জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কূটনীতিকেরা।

গাজা যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তির জন্য একটি চুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ব্যাপক চাপ রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চুক্তির বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, তারা দুটি ফ্রন্টে একযোগে যুদ্ধ চালাতে প্রস্তুত রয়েছে। এর একটি গাজা, অন্যটি লেবানন।

তবে হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহ অনেক বেশি শক্তিশালী। হিজবুল্লাহর ভান্ডারে প্রায় দেড় লাখ রকেট আছে। এর মধ্যে কিছু রকেট ইসরায়েলের যেকোনো জায়গায় হামলা চালাতে সক্ষম।

হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা হামাসের সদস্যদের চেয়ে বেশি দক্ষ-প্রশিক্ষিত ও উন্নত সরঞ্জামে সজ্জিত। তাঁদের অনেকের সিরিয়ায় যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা আছে।

প্রায় এক বছর ধরে গাজায় যুদ্ধ করার পর নতুন আরেকটি ফ্রন্টে পূর্ণমাত্রায় সংঘাত শুরুর বিষয়ে ইসরায়েলের সত্যিকারের ইচ্ছা-আগ্রহ আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

গাজা যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল হাজারো রিজার্ভ সেনাকে তলব করেছে। এখন যদি হিজবুল্লাহর সঙ্গেও ইসরায়েল পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়ায়, তখনকার পরিস্থিতি কী হবে, তা একটি বিবেচ্য বিষয়।

তবে অনেক ইসরায়েলি, বিশেষ করে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, হিজবুল্লাহকে অবশ্যই ভালোভাবে মোকাবিলা করতে হবে। উপযুক্ত জবাব দিতে হবে।

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের হামলার পর ধোঁয়া উড়ছে। ২৫ আগস্ট ২০২৪

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর হাজারো মানুষকে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে অনেক ইসরায়েলির ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো মানুষ ইসরায়েলি হামলার ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, কমান্ডার শোকর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া ক্ষেত্রে ‘প্রথম পর্যায়’ সম্পন্ন হয়েছে। যার অর্থাৎ প্রতিশোধের আরও পর্যায়ে আছে।

তবে হিজবুল্লাহর হামলায় ইসরায়েলে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কমই হয়েছে। উভয় পক্ষে কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ বলেছেন, ইসরায়েলের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রকেট ও ড্রোন হামলার প্রভাব মূল্যায়ন করবেন তাঁরা। এই মূল্যায়নের পর হিজবুল্লাহ ঠিক করবে, সংগঠনের কমান্ডার শোকর হত্যার বদলা নিতে তারা ইসরায়েলে আরও হামলা চালাবে কি না।

ইসরায়েল মনে করে, হিজবুল্লাহর একটি বড় পরিসরের হামলা তারা সফলভাবে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে কি এমন পাল্টাপাল্টি আন্তসীমান্ত সংঘাত চলতে থাকবে? নাকি গতকালের পাল্টাপাল্টি হামলা জেরে আরও বিপজ্জনক কিছুর সূত্রপাত ঘটবে?

ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর নেতারা অবশ্য বলছেন, তারা কেউই আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে চায় না।

তবে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ এ কথাও বলছে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।